শ্রদ্ধা ও আফতাব: বিপদ সংকেত কি গুরুত্ব পাবে!

- আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২২, বৃহস্পতিবার
- / 14
আহমদ হাসান ইমরান: শ্রদ্ধা ওয়াকারের মর্মান্তিক হত্যা এবং তাঁর প্রেমিকের (বয়ফ্রেন্ড) পশুর থেকেও নির্মম আচরণ শুধু সারাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচারিত হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই মানুষ হত্যার ভয়াবহতা জেনে বিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। হত্যার পর মেয়েটির দেহ ৩৫ টুকরো করা হয়েছে এবং ওই খুনি তা বেশকিছুদিন ধরে ফ্রিজে রাখে ও পরে দিল্লি-সন্নিহিত জঙ্গলে একে একে ফেলে দিয়ে আসে।
ঘটনাটির বিবরণ এখন এত বেশি প্রচারিত হয়েছে যে, তা ফের বিশদে বর্ণনা করার কোনও প্রয়োজন নেই। তবে এই হত্যা আমাদের সমাজের নতুন প্রজন্মের অবস্থান কোন দিকে যাচ্ছে, তার একটি হতাশাজনক চিত্র সামনে নিয়ে আসে।
একটা জিনিস লক্ষ করা যাচ্ছে, তথাকথিত সুশীল সমাজ, মিডিয়া এবং আইন-আদালতও মুক্ত-নয়া জীবনযাপন পদ্ধতির ঘোরতর সমর্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইদানীং মহামান্য আদালত সমকামিতা, লিভ-ইন রিলেশনশিপ, পরকীয়া, স্বামীকে ছেড়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে সহবাসের স্বাধীনতা সবকিছুকেই একের পর এক স্বীকৃতি দিয়ে চলেছে। আর তরুণ-তরুণীরাও ‘নয়া ডিজিটাল স্বাধীনতায়’ ভেসে চলেছে। নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দয়া, ভালোবাসা, পারিবারিক জীবনের সৌহার্দ্য, পারস্পরিক বোঝাপড়া, স্বার্থ ত্যাগ, এগুলি ক্রমশ তামাশার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যারা পর্ন মুভি করে বা করত তারা এখন খ্যাতি ও প্রচারের তুঙ্গে!
শ্রদ্ধা এবং আফতাবের কথাই ধরা যাক। শ্রদ্ধা আফতাবের সঙ্গে রিলেশনশিপ গড়ে তোলে। কি করে তাদের পরিচয় হল? পরিচয় ডেটিং অ্যাপে। চ্যাটিংয়ের ফুলঝুরিতেই হৃদয় সঁপে দেয় শ্রদ্ধা। আর তারপর, তার আর পর নেই…। শুরু হয় ডেটিং। ডেটিংয়ের অর্থ এখন আর শুধু ভালো ফ্যাশন করে রেস্তোরাঁয় খাওয়া নয়। সেসব থাক।
তবে একথা স্বীকার করতে হবে যে, শ্রদ্ধা আফতাবকে বিশ্বাস করেছিল। সে তার বাবা-মা, পরিবার সবাইকে ছেড়ে আফতাবের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। বারবার দেখা গেছে, এসব লিভ-ইন রিলেশনে থাকা মেয়েরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সমাজে শুধু মান-ইজ্জতই যায় না, বহুবার দেখা গেছে তারা হয় আত্মহত্যা করে কিংবা তাদের একসময়ের ভালোবাসার প্রেমিক তাদের কেটে কখনও ৩৫, কখনও ৭০ আবার কখনও বা ৩০০ টুকরো করে দিচ্ছে।
আফতাব যা করেছে তা গর্হিত, পাশবিক কাজ। কিন্তু কথা হচ্ছে, কেন মেয়েরা এবং ক্ষেত্রবিশেষে ছেলেরাও ডেটিং অ্যাপ, ফেসবুকের শো-বয় বা গার্লদের বিশ্বাস করবে। তাই তার ফল ১০০-তে একটিও ভালো হয় কি না, তাতে সন্দেহ আছে।
ডেটিং অ্যাপে ছেলেরা ‘ডেট’ করতে মেয়ে খোঁজে, বিয়ে করতে নয়। আসলে বিষয়টি ডেটিং অ্যাপের নির্মাতা, তা নিয়ে বাণিজ্য করা, ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে সঙ্গী খোঁজা প্রত্যেকেই বোঝেন। কিন্তু বর্তমানে যে ‘ডিজিটাল নয়া জামানা’, চলছে, তাতে কোনও সীমারেখা নেই, নেই কোনও নিয়ন্ত্রণ।
বালক ও কিশোর প্রজন্মকে সেক্স এডুকেশনের ব্যবস্থা করতে একটি লবি খুব সক্রিয়। কিন্তু তার থেকেও বেশি প্রয়োজন ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য অ্যাপ সম্পর্কে উঠতি কিশোর-কিশোরীদের জন্য বিশেষ শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা। আর নতুন করে ভাবতে হবে অভিভাবকদের দায়িত্বের কথা। শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদের নিজস্ব অভিমত গঠনের প্রক্রিয়াকে টেলিভিশন ও ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন, ফেসবুক জাতীয় প্রচার মাধ্যমের হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না। ওই অবাস্তব মোহপূর্ণ জগতের কথার সঙ্গে বাস্তবের যে মিল নেই, তা সন্তান-সন্ততীকে কী করে বোঝাবেন, তার পদ্ধতি বের করতে হবে।
কারণ, পাশ্চাত্যের কথা বাদ দিলে আমাদের সমাজেও কিন্তু শ্রদ্ধা ও আফতাবরা একা নয়। এই ধরনের অসংখ্য শ্রদ্ধা ও আফতাব রয়েছে, যারা প্রতিদিনই নৃশংসতার শিকার হচ্ছে। তবে এ কথা ঠিক, বীভৎসতার দিক থেকে আফতাবের ঘটনাটি সবাইকে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু দেশের সাম্প্রতি এমন বেশকিছু ঘটনা আছে, যেখানে এই ধরনের আরও বীভৎস ও নারকীয় খুনের ঘটনা রয়েছে।
যেমন ১২ বছর আগে দেহরাদুনে একজন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার রাজেশ গুলাতি তাঁর স্ত্রী অনুপমাকে খুনের পর দেহ ৭০ টুকরো করেছিলেন। আদালত এই পৈশাচিক অপরাধের জন্য তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়েছে। পৈশাচিকতা এখানেই শেষ নয়, ২০১৩ সালের ৩ জুন সোমনাথ পারিদা নামে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন চিকিৎসক তাঁর স্ত্রী ঊষসীকে ৩৫ বা ৭০ নয়, একেবারে ৩০০ টুকরো করেছিলেন। ঘটনাটি আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্য ওড়িশার ভুবনেশ্বরে। বোঝা যায় এরা মানসিক রোগী। এদের একজনের ঘটনা অন্য জনকে ‘অনুপ্রেরণা’ জোগায়। পুলিশ বলছে, আফতাব ভুবনেশ্বরের ঘটনাটি গুগলে বেশ কয়েকবার সার্চ করেছিল। আর আফতাবের খুনে গুরু বা শিক্ষকও ছিল ‘গুগল’। সে শ্রদ্ধাকে খুন করার পর গুগলে সার্চ করে কীভাবে দেহ লোপাট করবে, কীভাবে তা খণ্ডবিখণ্ড করবে, কীভাবে রক্তের দাগ কেমিক্যাল দ্বারা মুছবে সব বিষয়ে গুগল থেকে সাহায্য নেয়।
শ্রদ্ধার মর্মান্তিক হত্যার আর একটি দিকও সামনে এসেছে। কিছু উগ্রবাদী এই ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টা করছে। কলকাতার একটি প্রথম শ্রেণি হিন্দি কাগজের শিরোনাম হচ্ছে ‘মুসলিম প্রেমী নে….’। অর্থাৎ কি না মুসলিম প্রেমিক হিন্দু শ্রদ্ধা নামে তরুণীকে হত্যা করেছে। বিষয়টি কি সত্যি হিন্দু-মুসলিমের, যদি শ্রদ্ধা কোনও মুসলিম মেয়ে হ্ত, তাহলে কি আফতাব তাকে হত্যা থেকে বিরত থাকত? হিন্দু প্রেমিক কি হিন্দু প্রেমিকাকে হত্যা করে না?
মিডিয়ার পরিসংখ্যান কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছে। নাগপুরে ১৩ নভেম্বর একজন বাবা তার নাবালিকা মেয়েকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে। খবরটি পিটিআই-এর। বাবা এবং মেয়ে দু’জনেই হিন্দু।
আর একটি কথা, আফতাব কি সত্যিই মুসলিম, সে যদি মুসলিম হত তাহলে আফতাব কি যেনা বা ব্যভিচারে লিপ্ত হত? সে কি বিবাহবর্হিভূত যৌন সংসর্গে লাগাতার বসবাস করত? ইসলামে এই ধরনের যেনা বা ব্যভিচারের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। কাজেই আফতাব কে কোনও মতেই ‘মুসলিম’ বলা সঠিক হবে না। মুসলিমদের ঘরেই জন্মালেই কেউ ‘মুসলিম’ হয় না। যদি না সে ঈমান রাখে। যারা ব্যভিচার এবং অন্য ইসলাম-বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়, তাদেরকে অযথা ‘মুসলিম’ বানিয়ে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করা যায়। কিন্তু তা সঠিক নয়। কাজেই এই বিষয়টিতে ধর্মের ভেদাভেদ না করাই ভালো।
এই খুনের জন্য আফতাবের যাবজ্জীবন নয়, বরং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত। আশা করব, আদালত বিলকিস বানুর সঙ্গে সম্পর্কিত খুনি ও দর্শকদের যেভাবে মুক্তি দিয়েছে, আফতাব একইভাবে জামিন কিংবা মুক্তি পাবে না।