পুবের কলম প্রতিবেদক: জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার বিজবেহারার ওয়াঘামা অঞ্চলে বেড়ে ওঠা আমির হুসেন লোন ছোটবেলায় এক দুর্ঘটনায় নিজের দু’টি হাত খুইয়ে ছিলেন। ব্যাটের হ্যান্ডেল ধরার মতো দু’টি হাত তার আর না থাকলেও ক্রিকেটের প্রতি আমিরের আবেগ, ভালোবাসা কিন্তু একরত্তিও কমেনি। নিজের অক্ষমতাকে কখনোই তিনি সাফল্যের পথে আসতে দেননি। বরং সেই অক্ষমতাকে অস্ত্র করে ভিন্নভাবে সক্ষম হয়ে আজ আমির নিজের ব্যাটিং তুলির টানে রাঙিয়ে চলেছেন গোটা ক্রিকেট দুনিয়াকে। তাঁর এই হার না মানা জেদকে সম্মান জানিয়ে ভূ-স্বর্গে এসে সালাম ঠুকে গেলেন মাস্টার ব্লাস্টার শচীন তেন্ডুলকর। একা শচীন নন, বিশেষভাবে সক্ষম আমিরের ক্রিকেটের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছেন দেশের অন্যতম সেরা শিল্পপতি গৌতম আদানিও।
আমির হুসেন লোনের আজ দু’টি হাত না থাকলেও ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাস ও দৃঢ়তা দিয়েই তিনি নিজের জীবনের ট্র্যাজেডিগুলি জয় করেছেন। হাত না থাকায় ব্যাটের হ্যান্ডেল নিজের কাঁধ ও ঘাড়ের মধ্যিখানে চেপে ব্যাটিং করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন সর্বত্রে। আজ তিনি শুধু জম্মু ও কাশ্মীরের প্যারা ক্রিকেট দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন না, একইসঙ্গে সেই দলকে নেতৃত্বও দিচ্ছেন আমির।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ক্রিকেটের প্রতি আমি শুরু থেকেই খুব আগ্রহী ছিলাম। সাত বছর বয়স থেকেই এই খেলাটি খেলতে শুরু করি। দুর্ভাগ্যক্রমে, যখন আমার বয়স আট, তখন আমি একটি দুর্ঘটনায় কাঠেরমিলের করাতে নিজের দু’টি হাত হারিয়েছি। সেই তখন থেকেই আমার জীবন নানান ঘাত-প্রতিঘাত ও হতাশার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে যেতে শুরু করে। টানা তিন বছর হাসপাতালে কাটানোর পরে, বাড়ি ফিরে শুধু মানুষের সহানুভূতি পেয়েছি। কেউ কেউ আমার ™রিবারকে বলছে, আমার নাকি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা উচিত হয়নি। কারণ, শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে জীবনযাপন করা খুবই কঠিন হবে।’
পরবর্তীতে আমিরের দাদি ও পরিবার তাঁর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ শরীর থেকে দু’টি হাত না থাকা অনুভূতির সঙ্গেই তারা আমিরকে বাঁচার এবং লড়াইয়ের পাঠ দিতে থাকেন। এ বিষয়ে আমির আরও বলেন, ‘আমার জীবন শুরু থেকেই চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ। স্কুলে আমি অনেক অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। যার মধ্যে সামাজিক কুসংস্কারও ছিল। পরে বুঝলাম, এই বৈষম্য স্কুলের চার দেওয়ালের বাইরেও বিরাজমান। তার মধ্যেও ক্রিকেট খেলার আগ্রহ কমেনি। মাঝরাতে তেল পুড়িয়ে কাঁধ ও ঘাড়ের মধ্যিখানে ব্যাট রেখে ব্যাটিং অনুশীলন এবং পা দিয়ে বোলিং শুরু করি। কাজটা সহজ ছিল না। শুরুর সে যন্ত্রণা অসহনীয় ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই যন্ত্রণা আমাকে লড়াইয়ের শক্তি দিতে থাকে।’
আমিরের কঠোর পরিশ্রম শেষ পর্যন্ত তাঁকে জম্মু ও কাশ্মীরের প্যারা ক্রিকেট দলে জায়গা করে দেন। জম্মু ও কাশ্মীরের প্যারা ক্রিকেট দলকে প্রতিনিধিত্ব করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে দিল্লিতে আমি প্রথম জাতীয় স্তরে ম্যাচ খেলেছিলাম। ম্যাচ খেলতে বাংলাদেশ, নেপাল ও দুবাইয়ে গিয়েছি। আমি দেশের বিভিন্ন জায়গায় খেলেছি এবং সব জায়গায় অনেক ভালোবাসা, স্নেহ, প্রশংসা এবং সমর্থন পেয়েছি।’
নিজের সহনশীলতার মাধ্যমে আমির শুধু দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে ওঠেননি, একইভাবে চায়ের কাপ তোলা, বই ধরা, লেখালেখি করা, শেভ করা, কাপড় ধোয়া, স্মার্টফোনের ব্যবহার, চুল আঁচড়ানো-সহ পা দিয়ে নানা কাজে পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। ২০১৩ সালে মুম্বইয়ে গিয়ে ক্রিকেট খেলেছিলেন। তাঁকে হাত ছাড়া বোলিং ও ব্যাটিং করতে দেখে সবাই অবাক হয়ে যেতেন। ‘আমি ছোটবেলা থেকেই শচীন তেন্ডুলকরের বড় ভক্ত। অথচ তিনিই আমাকে তাঁর সই করা ব্যাট উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। এরজন্য আমি তাঁর কাছে চিরকতৃজ্ঞ। পাশাপাশি তাঁর মতো একজন ব্যক্তিত্ব আমার সঙ্গে এসে কাশ্মীরে দেখা করে গিয়েছেন, এটা স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাওয়ার মতো একটা ঘটনা।’ বলে জানান আমির।
আর্থিক সমস্যার কারণে যাতে তাঁর ক্রিকেট খেলায় কোনওদিন বাধা না আসে, সেটা মাথায় রেখে শিল্পপতি গৌতম আদানি আমিরের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে দেশের সর্বত্র ক্রিকেট খেলা আমির নিজের রাজ্য থেকে যে সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন, সেটা নাকি পাননি।
খানিকটা হতাশ এই প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারটি বলেন, ‘আমি মনে করি, দেশের নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলির উচিত বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের সাহায্য করা। যাতে তারাও তাদের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করতে পারে। তবে খারাপ লাগে, নিজের রাজ্য থেকে কোনও রকমের সাহায্য পেলাম না। তবে এখন আর সে-সব ভাবি না। এখন নিজের লড়াই নিজেকে লড়তে হবে, সেটা বেশ বুঝে গিয়েছি।’
একটু থেমে, ‘আমি যেখানেই যেতাম, সহানুভূতিশীল দৃষ্টি ও শধ দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানানো হত। বেচারা ছেলেটা। দুটো হাত নেই। কিছুই করতে পারছে না। আমি তাদের ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম। আজ কঠোর পরিশ্রম এবং হার না মানার জেদের মাধ্যমে আজ আমি সফল হয়েছি। আমি বিশ্বের সকল প্রতিবন্ধী মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে চেয়েছি। তাদের বলতে চেয়েছি, হতাশায় নিজের জীবন নষ্ট করবেন না। কখনও পরাজয় মেনে নেবেন না। লক্ষ্য পূরণে নিষ্ঠা ও উদ্যমের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করুন। তাহলে কেউ আপনাকে সফল হতে আটকাতে পারবে না।’