এ হাসান: পিটিআই পরিবেশিত খবরে প্রকাশ, সোমবার সাঁইথিয়াতে ভাষণ দিতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘দাঙ্গার চক্রান্তকারী কাউকে কি আপনারা দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান?’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বক্তব্য অনেককেই চমকে দিয়েছিল।
দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ‘দাঙ্গার চক্রান্তকারী’ বলা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যে সে কথা নয়। কিন্তু যারা ২০২৪-এর নির্বাচনী লড়াই শুরু হওয়ার পর বিজেপির ভোট প্রচার সম্পর্কে অবগত রয়েছেন, তারা জানেন যে, প্রথম পর্বের ভোট শেষ হওয়ার পরই বিজেপি রামমন্দির, উন্নয়ন, বিকাশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দ্রব্যমূল্য, রোজগার এসব নিয়ে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে। কারণ, বিজেপি বুঝতে পেরেছে, এই বিষয়গুলিতে নাগরিকদের কাছে বলার মতো তাদের ভাঁড়ারে খুব বেশি কিছু নেই। এমনকী অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জমিতে রাম মন্দির নির্মাণের বিষয়টি নিয়েও মানুষের মধ্যে তেমন আর উদ্দীপনা নেই।
দেখা যাচ্ছে যে, হাওয়া বরং ইন্ডিয়া জোটের দিকেই ঝুঁকে রয়েছে। আর সেদিন থেকেই বিজেপির নির্বাচনী প্রচারের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে এক, দেশের মুসলিম সম্প্রদায় আর দুই, কংগ্রেস দল। কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া জোট আদিবাসী, তপশিলি ও হিন্দুদের কাছ থেকে সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেবে, এগুলি বলছেন ১০ বছর ধরে যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খোদ সেই নরেন্দ্র মোদি।
তিনি ভারতের মুসলিমদের আখ্যায়িত করেছেন ‘ঘুসপেটিয়া’ নামে। অর্থাৎ তারা অনুপ্রবেশকারী। বোধহয় শুধু মোদি ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরাই হচ্ছেন ‘প্রবেশকারী’। মোদি ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে ঘৃণা ছড়ানোর জন্য বলছেন, তাদেরকেই সম্পদ দেওয়া হবে, যাদের বেশি বাচ্চা হয়। অথচ খোদ মোদির পিতারই ছয় ছয়টি সন্তান।
এখানেই শেষ নয়, রাজস্থানে মোদির সেই কুখ্যাত ভাষণে তিনি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদকে আরও উসকে দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য বলে যাচ্ছেন যে, ‘কংগ্রেস বা ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে হিন্দু, আদিবাসী ও দলিত মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেবে’। মঙ্গলসূত্র কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে বণ্টন করবে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি বুঝে গেছেন, দেশে মুসলিম বনাম হিন্দু এই ধরনের ঘৃণা-বিদ্বেষ চাগিয়ে তুলতে না পারলে তাঁর ‘৪০০ পার’ তো হবেই না বরং মসনদ উলটে যাওয়ার সম্ভাবনা। তাই দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নির্বাচনী কোড সব কিছুকে বাতিল করে তিনি এবং তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সমানে টার্গেট করে চলেছেন ভারতের মুসলিম নাগরিকদের। এ কাজে তাঁরা কোনও কিছুরই পরোয়া করছেন না। তাঁদের ঘৃণা ভাষণ ও সাম্প্রদায়িক উসকানি সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
তাই ‘হিন্দু সেন্টিমেন্ট’-এ আঘাত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদি মঙ্গলবার মধ্যপ্রদেশের ধার লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির সভায় বলেছেন, ‘কংগ্রেসের লক্ষ্য হল, বাবরি মসজিদের খোলা তালা এনে রামমন্দিরে ঝুলিয়ে দেওয়া এবং তারা বাবরি মসজিদ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে পালটে দেবে। যেমন, সুপ্রিম কোর্টের রায়কে শাহবানু মামলায় পার্লামেন্টের মাধ্যমে আইন পাশ করে রাজীব গান্ধি পরিবর্তিত করে দিয়েছিলেন।’
মোদিজি কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন, রামমন্দির, বাবরি মসজিদের তালা এই রাজীব গান্ধির সময়ই খুলে দেওয়া হয়েছিল এবং বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে তারপর থেকেই সীতা ও রামলালার পূজা-পাঠ শুরু হয়েছিল। মোদি আরও বলছেন, তপশিলি জাতি, দলিত, ওবিসি সবার সংরক্ষণ কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের দিয়ে দেওয়া হবে। কেউ এসব কথা বলেনি। তাও মোদিজি কিন্তু মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন। মিথ্যাচার করছেন কংগ্রেসের ইশতেহার নিয়েও।
তিনি বলছেন, কংগ্রেস ইশতেহারে নাকি এই সব কথাই লেখা রয়েছে, যা ডাহা মিথ্যা। তাই মমতা ব¨্যােপাধ্যায় বলেছেন, দেশে এখন কোনও নির্বাচনী কোড অফ কনডাক্ট চালু নেই। কারণ, নির্বাচন কমিশন বিজেপি অঙ্গুলি হেলনেই চলছে। তাই দেশে যা এখন চলছে, তাহল ‘মোদি কোড অফ কনডাক্ট’।
আর মুখে সংবিধান পালটানো হবে না, এ কথা বললেও মোদি, অমিত শাহ, যোগী এবং তাঁদের দল বিজেপি কার্যত যা করছে তা হল, সংবিধান, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার সব কিছুরই সম্পূর্ণ উল্লঙ্ঘন।মোদি, শাহ, যোগীরা জনসাধারণকে বোঝাতে চাইছেন, ‘ইন্ডিয়া জোট’ জেতা মানে মুসলিমদের বিজয়।
সব থেকে পরিষ্কার কথা বলে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ২১ এপ্রিল, ২০২৪ তিনি বলেছেন, যদি কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তাহলে সারাদেশে মাস কিলিং বা গণহত্যা এবং দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বিহারের কাঠিহারে এই বক্তব্য রাখেন। তিনি ভীতি প্রদর্শন করে বলেন, তারা দেশের দাঙ্গা, জুলুম নির্যাতন এবং দারিদ্র্য নিয়ে আসবে।
এখন কথা হচ্ছে, অমিত শাহ যে গণহত্যা বা দাঙ্গার কথা বলছেন তা কার সঙ্গে কার দাঙ্গা? অবশ্যই তিনি সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সংখ্যাগুরুদের দাঙ্গার কথা বলে ভয় দেখাচ্ছেন। এই ধরনের ভীতি প্রদর্শন করে কি নির্বাচনে জেতা যায়?
হ্যাঁ যায়। গুজরাতে ২০০২ সালে যে সংখ্যালঘু বিরোধী গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল এবং ওই রাজ্যের তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। তখন তিনি যেসব কথা উচ্চারণ করেছিলেন, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী হয়েও আবার তা বলা শুরু করেছেন। গুজরাত মডেলকেই তিনি ভারতের জন্য ফের বেছে নিয়েছেন।
তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য বিরোধী নেতারা ঠিক কথাই বলেছেন, ২০২৪-এর এই নির্বাচন হয়তো দেশের শেষ গণতান্ত্রিক নির্বাচন। এরপর আর নির্বাচনের সুযোগই জনগণকে দেওয়া হবে না। তার একটি উদাহরণ হচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের সম্বলে এবার মুসলিমদের ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। আধা সামরিক বাহিনী, পুলিশ মুসলিম ভোটদাতাদের নির্মমভাবে পিটিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে। হয়তো এটি ভবিষ্যতের ‘মোদি-গণতন্ত্রের’ একটি উদাহরণ।