বিজেপি বনাম সিপিএম: মোদী-মমতা ‘সেটিং’ বিতর্কে কালীগঞ্জ উপনির্বাচন ঘিরে পাল্টা জবাব?

- আপডেট : ২ জুলাই ২০২৫, বুধবার
- / 44
পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘মোদী-মমতা সেটিং’ তত্ত্ব ঘিরে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। সিপিএমের তোলা এই অভিযোগ রাজ্যের রাজনৈতিক আলোচনায় বারবার ফিরে এসেছে এবং বিজেপিকে বারবার ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী ও রাজ্যের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে কোনও গোপন সমঝোতা আছে কি না, ‘কেন্দ্রে মোদী, রাজ্যে দিদি’ ফর্মুলা আসলে কোনও রাজনৈতিক চুক্তির প্রতিফলন কি না — এই প্রশ্ন ঘুরেফিরে এসেছে রাজনীতির ময়দানে।
এত দিন ধরে বিজেপি এই তত্ত্বকে বারবার অস্বীকার করলেও, তেমন কোনও দৃঢ় পাল্টা বার্তা তারা দিতে পারেনি বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের দাবি। তবে সদ্যসমাপ্ত কালীগঞ্জ উপনির্বাচনে বিজেপি এক নতুন যুক্তি তুলে ধরেছে, যা এই বিতর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় আনতে পারে বলেই মনে করছে দলের একাংশ।
১৯ জুনের কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের প্রচারের সময়ে, বিজেপির সংগঠন সচিব অমিতাভ চক্রবর্তী দলীয় এক কর্মীর মুখোমুখি হন যিনি সরাসরি বলেন, ‘‘চায়ের দোকানে সকলে বলে, দিদি-মোদী সেটিং রয়েছে। এতে প্রচারে অসুবিধা হচ্ছে।’’
এর উত্তরে অমিতাভের যুক্তি ছিল, তিনি আগে ওড়িশায় সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন। সেখানে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক প্রতি মাসে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। এমনকি তিনি জগন্নাথদেবের প্রসাদও উপহার দিতেন। তখনও সকলে বলতেন, “নবীন-মোদী সেটিং চলছে”। কিন্তু সেই অবস্থার মধ্যেও বিজেপি অবিচল ছিল এবং অবশেষে ওড়িশায় নবীন পট্টনায়কের সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে বিজেপি সরকার গঠন করেছে।
বিজেপির একাংশ মনে করছে, এই উদাহরণ ‘সেটিং তত্ত্ব’কে খণ্ডন করার মতো প্রথম কার্যকরী ভাষ্য, যা ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে দলের প্রচারে ব্যবহার করা যাবে। এত দিন পর্যন্ত বিজেপি নেতারা সিবিআই, ইডি অভিযান, তৃণমূলের সঙ্গে সংঘর্ষ বা প্রকল্পের টাকা আটকে যাওয়ার মতো বিষয় তুলে ধরতেন। কিন্তু কোনও ইতিহাসনির্ভর প্রমাণ ছিল না তাদের ঝুলিতে। এই প্রথম এক সংগঠনিক নেতা অতীতের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে যুক্তি সাজিয়েছেন।
রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র ও সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য মনে করেন, অমিতাভের উদাহরণ যথাযথ। তাঁর মতে, ‘‘২০২৬ সালের ভোটে এই মনগড়া তত্ত্বের কোনও গুরুত্ব থাকবে না। তৃণমূলকে পরাজিত করতে পারে একমাত্র বিজেপি, এ কথা মানুষ জানেন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সিপিএমের বানানো তত্ত্বে কোনও বাস্তবতা নেই। মানুষ বাস্তব দেখেই ভোট দেন।’’
তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন, ‘‘সেটিং তত্ত্ব কাগুজে গল্প। কোনও দল যদি কোনও দলের সঙ্গে জোট করে, তা হলে বোঝা যায়। কিন্তু তেমন কিছু না হলে এই ধরনের গল্পের উপর ভিত্তি করে ভোট হয় না।’’ তিনি সরাসরি বলেন, ‘‘যাঁদের জনসমর্থন নেই, তাঁরাই অন্য দলের বিরুদ্ধে কুৎসা করে ভোট জেতার চেষ্টা করেন।’’
সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম পুরো বিষয়টিকে তাঁদের তত্ত্বেরই মান্যতা বলে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর কথায়, ‘‘ওড়িশায় নবীন-মোদীর সুসম্পর্ক ছিল এবং সংসদে বিজেপি বারবার বিজেডির সমর্থন পেয়েছে। বিজেপি যখন মনে করেছে, ওড়িশায় নিজেরাই ক্ষমতা নিতে পারবে, তখন বিজেডিকে সরিয়ে দিয়েছে।’’
সেলিমের আরও অভিযোগ, ‘‘পশ্চিমবঙ্গেও একই ঘটনা ঘটবে। তৃণমূলকে বিজেপিই টিকিয়ে রেখেছে যাতে বামেরা না ফিরে আসে। কিন্তু যখন সময় আসবে, বিজেপি তৃণমূলকে সরিয়ে দেবে এবং তখন তৃণমূলেরই একটা অংশ বিজেপিতে মিশে যাবে।’’ তিনি দিল্লির উদাহরণ টেনে বলেন, ‘‘দিল্লিতেও এই কৌশলেই ক্ষমতা দখল করেছে বিজেপি। আপের সঙ্গে বিরোধ ছিল, কিন্তু তবু তাদের সরিয়ে দিয়েছে। আর তৃণমূল তো নীতিগত কোনও বিরোধই করছে না।’’
২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে ‘সেটিং’ তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক যে আরও তীব্র হবে, তা স্পষ্ট। কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বিজেপি যদি একটি শক্তিশালী পাল্টা ভাষ্য তৈরি করতে পারে, তবে তৃণমূল ও সিপিএমের সঙ্গে তাদের বাগ্যুদ্ধ আরও ধারালো হবে। তবে শেষ পর্যন্ত জনগণ কী ভাবেন, তা-ই নির্ধারণ করবে বঙ্গ রাজনীতির ভবিষ্যৎ।