০৭ অগাস্ট ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
অস্তিত্বের সংকটে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল

বিশ্বের বদ্বীপ সুন্দরবনের ভূমিক্ষয়

মারুফা খাতুন
  • আপডেট : ৬ অগাস্ট ২০২৫, বুধবার
  • / 28

কুতুব উদ্দিন মোল্লা, সুন্দরবন : বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, যা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনার মোহনায় বিস্তৃত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই বনভূমি জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এবং উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে।

তবে বর্তমানে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় পরিবেশগত সংকটগুলোর একটি হলো ভূমিক্ষয়। জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, অতিরিক্ত চর জমানো ও মানুষজনের অবৈজ্ঞানিক হস্তক্ষেপের ফলে প্রতিবছর বিস্তীর্ণ জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো ক্যানিং-জয়নগর সংযোগকারী পিয়ালি নদীর বাঁশের সাঁকো

ভূমিক্ষয়ের প্রাকৃতিক কারণ :

আরও পড়ুন: মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার বিএলসি পাস এখনো না পাওয়ায় ক্ষোভ সুন্দরবনের মৎস্যজীবিদের মধ্যে

গঙ্গা ও মাতলা, বিদ্যাধরী, রায়মঙ্গল প্রভৃতি নদীর জলের প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে পাড় ভাঙনের মাত্রা বেড়েছে। নদীর তীব্র স্রোত সুন্দরবনের অনেক দ্বীপের মাটি প্রতিনিয়ত ক্ষয় করে চলেছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানির পরিমাণ কমে গেলে চর তৈরি হয় এবং বর্ষায় বা জোয়ারে সেই চর নদীর গতিপথ বদলে দেয়, যা ভূমিক্ষয়ের হার বাড়ায়।

বঙ্গোপসাগরে সাগরের জলস্তর বাড়ছে বছরে গড়ে ৩-৫ মিমি করে। এর ফলে নদী ও সমুদ্রের মধ্যে জোয়ার-ভাটার পার্থক্য বেড়েছে। জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় তীব্র জোয়ারের ঢেউ মাটি ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে, ফলে নদীবাঁধ ও জমি ধ্বংস হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আইলা (২০০৯), আমফান (২০২০), ইয়াস (২০২১)-এর মতো দুর্যোগে সুন্দরবনের বহু জায়গায় ব্যাপক ভূমিক্ষয় হয়েছে। এসব দুর্যোগে নদী বাঁধ ভেঙে গিয়ে নদী তার গতি পরিবর্তন করেছে, নদীর পাড় ধসে গেছে।

মানবসৃষ্ট কারণ সুন্দরবনের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে দিন দিন জনবসতি বাড়ছে। অনেক জায়গায় গাছ কেটে বসতি, চাষাবাদ বা পুকুর খননের জন্য জমি ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করা ম্যানগ্রোভ গাছপালা কমে যাচ্ছে, ফলে নদীর ঢেউ সরাসরি মাটি ক্ষয় করছে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জমি উজাড় করে চিংড়ি বা বাগদা চাষের জন্য ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করা হয়েছে।

অনেক সময় নদী থেকে জল টেনে আনতে বা জল নামাতে খোঁড়া নালা দিয়ে জোয়ারের জল প্রবেশ করে, যা ভূমিক্ষয়ের হার বাড়ায়।রাস্তাঘাট, বাঁধ বা ইটভাটা ইত্যাদি স্থায়ী নির্মাণ কাজের ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ও জলের প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, যা ভূমিক্ষয়ের ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে।

বিশ্বের বদ্বীপ সুন্দরবনের ভূমিক্ষয়

পরিণতি সুন্দরবনের বহু পরিবার তাদের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, স্কুল, ধর্মীয় স্থাপনা নদীতে হারিয়েছে। এক হিসাব অনুযায়ী, বিগত তিন দশকে পশ্চিমবঙ্গ অংশের প্রায় ২২০ বর্গকিমি জমি নদীতে ভেঙে গেছে। ভূমিক্ষয়ের ফলে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। অনেকে শহরে গিয়ে বস্তিতে ঠাঁই নিচ্ছে।

সুন্দরবনের জয়নগর, বাসন্তী, কুলতলি, গোসাবা, সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জের বহু পরিবার অভ্যন্তরীণ উদ্বাসুতে পরিণত হয়েছে। ভূমিক্ষয়ের কারণে হরিণ, বানর, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীদের বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে। নদীর পাড় ভেঙে মাটি জলে মিশে জলজ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ম্যানগ্রোভের অকাল ধ্বংস প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস করছে।

প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ : 

স্থানীয় সামাজিক সংগঠন যেমন ‘ঝড়খালী সবুজ বাহিনী’, ‘সুন্দরবন সোসাইটি’ প্রভৃতি ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানোর কাজ করছে। সরকারি উদ্যোগেও এখন নদীপাড়ে কেওড়া, সুন্দরী, গরান, বাঁকড়া প্রভৃতি ম্যানগ্রোভ চারা রোপণ করা হচ্ছে। কংক্রিট বাঁধের পরিবর্তে ‘জিও ব্যাগ’ ও প্রাকৃতিক উপায়ে বাঁধ মজবুত করার কাজ শুরু হয়েছে। বাঁধ ও রাস্তা তৈরির সময় প্রাকৃতিক জলচক্র ও নদীর গতিপথ মাথায় রেখে পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।

স্থায়ী সমাধানের জন্য স্থানীয় মানুষদের নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। মহিলাদের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে ‘টাইগার উইডো’ এবং মৎস্যজীবী মহিলাদের প্রশিক্ষণ ও কাজে অন্তর্ভুক্ত করা হলে কার্যকারিতা বাড়ে। ভূমিক্ষয়ের হারের ওপর নিয়মিত গবেষণা, উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণ ও জলস্তর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আগাম সতর্কতা জারি করতে হবে। এর ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে রূপরেখা তৈরি করা প্রয়োজন।

সুন্দরবনের ভূমিক্ষয় শুধু একটি প্রাকৃতিক বা স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের বহিঃপ্রকাশ। নদীবাঁধ ভেঙে পড়া, বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হওয়া, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ও মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তা – সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে।

এই সংকট মোকাবেলায় চাই সরকার, বিজ্ঞানী, স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমন্বিত প্রয়াস। যদি সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এই অমূল্য বৈশ্বিক ঐতিহ্য চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

অস্তিত্বের সংকটে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল

বিশ্বের বদ্বীপ সুন্দরবনের ভূমিক্ষয়

আপডেট : ৬ অগাস্ট ২০২৫, বুধবার

কুতুব উদ্দিন মোল্লা, সুন্দরবন : বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, যা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনার মোহনায় বিস্তৃত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই বনভূমি জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এবং উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে।

তবে বর্তমানে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় পরিবেশগত সংকটগুলোর একটি হলো ভূমিক্ষয়। জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, অতিরিক্ত চর জমানো ও মানুষজনের অবৈজ্ঞানিক হস্তক্ষেপের ফলে প্রতিবছর বিস্তীর্ণ জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো ক্যানিং-জয়নগর সংযোগকারী পিয়ালি নদীর বাঁশের সাঁকো

ভূমিক্ষয়ের প্রাকৃতিক কারণ :

আরও পড়ুন: মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার বিএলসি পাস এখনো না পাওয়ায় ক্ষোভ সুন্দরবনের মৎস্যজীবিদের মধ্যে

গঙ্গা ও মাতলা, বিদ্যাধরী, রায়মঙ্গল প্রভৃতি নদীর জলের প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে পাড় ভাঙনের মাত্রা বেড়েছে। নদীর তীব্র স্রোত সুন্দরবনের অনেক দ্বীপের মাটি প্রতিনিয়ত ক্ষয় করে চলেছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানির পরিমাণ কমে গেলে চর তৈরি হয় এবং বর্ষায় বা জোয়ারে সেই চর নদীর গতিপথ বদলে দেয়, যা ভূমিক্ষয়ের হার বাড়ায়।

বঙ্গোপসাগরে সাগরের জলস্তর বাড়ছে বছরে গড়ে ৩-৫ মিমি করে। এর ফলে নদী ও সমুদ্রের মধ্যে জোয়ার-ভাটার পার্থক্য বেড়েছে। জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় তীব্র জোয়ারের ঢেউ মাটি ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে, ফলে নদীবাঁধ ও জমি ধ্বংস হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আইলা (২০০৯), আমফান (২০২০), ইয়াস (২০২১)-এর মতো দুর্যোগে সুন্দরবনের বহু জায়গায় ব্যাপক ভূমিক্ষয় হয়েছে। এসব দুর্যোগে নদী বাঁধ ভেঙে গিয়ে নদী তার গতি পরিবর্তন করেছে, নদীর পাড় ধসে গেছে।

মানবসৃষ্ট কারণ সুন্দরবনের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে দিন দিন জনবসতি বাড়ছে। অনেক জায়গায় গাছ কেটে বসতি, চাষাবাদ বা পুকুর খননের জন্য জমি ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করা ম্যানগ্রোভ গাছপালা কমে যাচ্ছে, ফলে নদীর ঢেউ সরাসরি মাটি ক্ষয় করছে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জমি উজাড় করে চিংড়ি বা বাগদা চাষের জন্য ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করা হয়েছে।

অনেক সময় নদী থেকে জল টেনে আনতে বা জল নামাতে খোঁড়া নালা দিয়ে জোয়ারের জল প্রবেশ করে, যা ভূমিক্ষয়ের হার বাড়ায়।রাস্তাঘাট, বাঁধ বা ইটভাটা ইত্যাদি স্থায়ী নির্মাণ কাজের ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ও জলের প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, যা ভূমিক্ষয়ের ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে।

বিশ্বের বদ্বীপ সুন্দরবনের ভূমিক্ষয়

পরিণতি সুন্দরবনের বহু পরিবার তাদের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, স্কুল, ধর্মীয় স্থাপনা নদীতে হারিয়েছে। এক হিসাব অনুযায়ী, বিগত তিন দশকে পশ্চিমবঙ্গ অংশের প্রায় ২২০ বর্গকিমি জমি নদীতে ভেঙে গেছে। ভূমিক্ষয়ের ফলে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। অনেকে শহরে গিয়ে বস্তিতে ঠাঁই নিচ্ছে।

সুন্দরবনের জয়নগর, বাসন্তী, কুলতলি, গোসাবা, সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জের বহু পরিবার অভ্যন্তরীণ উদ্বাসুতে পরিণত হয়েছে। ভূমিক্ষয়ের কারণে হরিণ, বানর, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীদের বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে। নদীর পাড় ভেঙে মাটি জলে মিশে জলজ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ম্যানগ্রোভের অকাল ধ্বংস প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস করছে।

প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ : 

স্থানীয় সামাজিক সংগঠন যেমন ‘ঝড়খালী সবুজ বাহিনী’, ‘সুন্দরবন সোসাইটি’ প্রভৃতি ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানোর কাজ করছে। সরকারি উদ্যোগেও এখন নদীপাড়ে কেওড়া, সুন্দরী, গরান, বাঁকড়া প্রভৃতি ম্যানগ্রোভ চারা রোপণ করা হচ্ছে। কংক্রিট বাঁধের পরিবর্তে ‘জিও ব্যাগ’ ও প্রাকৃতিক উপায়ে বাঁধ মজবুত করার কাজ শুরু হয়েছে। বাঁধ ও রাস্তা তৈরির সময় প্রাকৃতিক জলচক্র ও নদীর গতিপথ মাথায় রেখে পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।

স্থায়ী সমাধানের জন্য স্থানীয় মানুষদের নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। মহিলাদের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে ‘টাইগার উইডো’ এবং মৎস্যজীবী মহিলাদের প্রশিক্ষণ ও কাজে অন্তর্ভুক্ত করা হলে কার্যকারিতা বাড়ে। ভূমিক্ষয়ের হারের ওপর নিয়মিত গবেষণা, উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণ ও জলস্তর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আগাম সতর্কতা জারি করতে হবে। এর ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে রূপরেখা তৈরি করা প্রয়োজন।

সুন্দরবনের ভূমিক্ষয় শুধু একটি প্রাকৃতিক বা স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের বহিঃপ্রকাশ। নদীবাঁধ ভেঙে পড়া, বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হওয়া, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ও মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তা – সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে।

এই সংকট মোকাবেলায় চাই সরকার, বিজ্ঞানী, স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমন্বিত প্রয়াস। যদি সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এই অমূল্য বৈশ্বিক ঐতিহ্য চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।