ভারতীয় চলচ্চিত্রের রূপ নির্মাণের কারিগর
দিলীপ কুমার: ৪ র্থ প্রয়াণ দিবসে স্মরণ ট্র্যাজেডি কিংকে

- আপডেট : ৮ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার
- / 226
বিশেষ প্রতিবেদন: দিলীপকুমার সম্বন্ধে তাঁর সহ-অভিনেতা, চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদ ও সিনেমামোদীরা কী বলেন? তিনি এক ফেনোমেনা। সহজাত স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্রাভিনয়ে দক্ষ, বহুভাষিক। তিনি এমন একজন দক্ষ অভিনেতা যিনি মন, স্বর ও দেহভঙ্গির সমন্বয় গড়ে তুলতে পারতেন রুপোলি পর্দায়। সোমবার তাঁর ৪র্থ প্রয়াণ দিবস ছিল। ২০২১ সালের ৭ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
দিলীপকুমার কেবলমাত্র নম্র, কোমল, ভদ্র ও অভিজাত ছিলেন না, সেই সঙ্গে তাঁর অভিনয়কলা ভারতীয় সিনেমার প্রথমসারির অভিনেতা ও তাত্ত্বিকদের চিরকালই মুগ্ধ করেছে এবং তাঁরা ছিলেন এই ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
কোনও ফিল্ম বা নাটকের স্কুলে তিনি কখনও শিল্পকলা বিষয়ে পাঠ নেননি। কিন্তু তাঁর স্বকীয় অভিনয় পদ্ধতি ছিল। ছিল নিজস্ব ছন্দ, ভঙ্গি, ওঠাপড়া ও ভার।
ভারতের বহুস্বর সমন্বিত চরিত্রের প্রতিফলন ঘটেছে বহুভাষিক দিলীপ সাহাবের মধ্যে। নিজের মাতৃভাষার পাশাপাশি তিনি জানতেন ও ঝরঝর করে বলতে পারতেন উর্দু, হিন্দি, পুশতু, পাঞ্জাবি, মারাঠি, ইংরেজি, বাংলা, গুজরাতি, ফারসি, ভোজপুরি ও আওয়াধি।
বর্তমানের কলরবের পরিবেশে তার মৃত্যুবার্ষিকী যেন ভারতীয় সিনেমায় এক দিকচিহ্ন স্বরূপ। এক অনন্য সাধারণ ভদ্রতা ও পরিমিতি বোধকে সূচিত করে। বর্তমানের পাকিস্তানের পেশোয়ারের কিসসা খাওয়ানি বাজারে জন্ম ইউসুফ খানের। এই এলাকা ভীষণ ঘনবসতিপূর্ণ ও জনসমাকীর্ণ। তাঁর পিতা লালা গুলাম সারওয়ার খান এবং মা আয়েশা বেগম। ইউসুফ খানের এগারোজন ভাইবোন।
কুড়ির কোঠায় তাঁর যখন বয়স তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন, অভিনয়কেই পেশা বানাবেন। দিলীপ কুমার নাম রাখতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কিংবদন্তী অভিনেত্রী ও প্রযোজক দেবিকা রানি।
১৯৪৪ সালের ‘জোয়ার ভাঁটা’ থেকে ১৯৯৮ সালের ‘কিলা’- দিলীপ কুমারের দীর্ঘ ৫৬ বছর ব্যাপী সিনেমাজীবন। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশক ছিল দিলীপ কুমারের স্বর্ণযুগ। ভারতীয় সিনেমারও সোনার যুগ এই সময়কাল। ১৯৪৯ সালে মেহবুব খান একটি ছবি নির্মাণ করেন। এই ছবির নাম ‘আন্দাজ’। দিলীপ কুমারের সঙ্গে এই সিনেমায় অভিনয় করেন নার্গিস ও দিলীপ সাহেবের বাল্য-প্রতিবেশী রাজ কাপুর। এই ছায়াছবি দিলীপ কুমারকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। পরের বছরই তিনি নার্গিসের সঙ্গে আরও একটি ছবি করেন। নাম ‘যোগান’।
ট্রাজেডি ও কমেডির মধ্যে তাঁর ছিল অনায়াস গতায়াত। ‘পয়গাম’, ‘রাম আওর শ্যাম’ থেকে ‘আন’, ‘আজাদ’, ‘কোহিনূর’ ও ‘মুঘল-এ-আজম’- নিপূণভাবে অভিনয় করেছেন প্রতিটি চরিত্রে।‘তাঁর আত্মবিশ্বাসের মধ্যে ছিল এক প্রাণবন্ত ব্যাপার।’ দিলীপ কুমারের স্ক্রিন ব্যক্তিত্ব বিবর্তিত হয়েছে বেশ কয়েকজন বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালকের হাত ধরে যেমন নীতিন বোস (দিদার ও গঙ্গা যমুনা), তপন সিনহা (সাগিনা মাহাতো) এবং বিমল রায় (দেবদাস ও মধুমতী)। গত শতকের সত্তরের দশক অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে এই অভিনেতার। তবে, আশি ও নব্বইয়ের দশকে তিনি আবার ঘুরে দাঁড়ান। এই সময়ে মুক্তি পায় সুভাষ ঘাই পরিচালিত ‘কর্মা’, ‘সওদাগর’, ‘বিধাতা’, ‘রমেশ সিপ্পির ‘শক্তি’।
সিপ্পির এই ছবিতেই তাঁর সঙ্গে প্রথম অভিনয় করেন আর এক জীবন্ত কিংবদন্তী অমিতাভ বচ্চন। দিলীপ কুমারের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নিয়ে সব সময়ই সরব থাকেন বচ্চন এবং তাঁকে নিজের আইডল বলেন। ‘বিশ্ব সিনেমা ও সমাজে দিলীপ কুমার একজন ফেনোমেনন। তিনি কেবলমাত্র পাঁচ দশকের সুপারস্টার নন, বরং একজন গভীর মানুষ।’
দীর্ঘ অভিনয় জীবনে দিলীপ কুমার ৬৫টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। কিন্তু এই সংখ্যাটাই শেষ কথা নয়। শিল্পী হিসেবে তাঁর বিস্তার ও সচেতনতাই তাঁকে চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী বানিয়েছে। যাঁরা অল্প পরিশ্রম করেন, তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি যেটা করতে চাইতেন, সেটাই বেছে নিতেন এবং তার উপর ভীষণ পরিশ্রম করতেন। কখনও কখনও দুই-তিন বছর পরে তাঁর সিনেমা মুক্তি পেত। এদিকে, অধিকাংশ অভিনেতাই বছরে দুই-তিনটে ছবি করে ফেলতেন। আর দিলীপ কুমার যে কাজ করতেন সেই কাজে ভীষণ ভাবে মনোযোগ দিতেন। এর পিছনে অনেক শক্তি ব্যয় করতেন। অমিতাভ বচ্চন থেকে নাসিরুদ্দিন শাহ, শাহরুখ খান থেকে নাওয়াজুদ্দিন সিদ্দিক, হিন্দি সিনেমার সকল অভিনেতার মধ্যেই দিলীপ কুমারের প্রতিফলন রয়েছে।
এদিন বর্ষীয়ান অভিনেতা-রাজনীতিক শত্রুঘ্ন সিনহা বলেন, যিনি ‘ক্রান্তি’ ছবিতে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছিলেন, বলেন, ভারতে সমস্ত শিল্পী অবচেতন ভাবে দিলীপ কুমারের কাছ থেকে বহু কিছু শিখেছেন। সিনহা আরও বলেন, ‘আমাদের সবার উপরে দিলীপ সাহেবের অপরিসীম প্রভাব রয়েছে। আমরা অবচেতনে অনেক কিছুই তাঁর কাছ থেকে শিখেছি যেমন তাঁর গভীরতা, সততার সঙ্গে তিনি যেভাবে প্রতিটি দৃশ্য রচনা করতেন। তিনি ছিলেন ট্রাজেডি ও কমেডির কিং। তিনি সব কিছুই করতে পারতেন।’
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও ব্যক্তিকে স্মরণীয় ও সম্মাননীয় করে তোলে তাঁর মানবিকতা। চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ ঘাইয়ের মতে, অভিনয় প্রতিভা ছাড়াও এই পৃথিবীকে আরও অনেক কিছু দেওয়ার ছিল দিলীপ কুমারের আর তা হল, জীবন সম্পর্কে এক বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি। এরই সঙ্গে পরিচালক আরও যোগ করেন, ‘তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি নিজের কাজের বাইরেও বহু কিছু নিয়ে চিন্তা করতেন যেমন দেশ, সমাজ, মানুষ। তাঁর মধ্যে কোনও দেখানেপনা ছিল না। চলচ্চিত্র কর্মী, অন্ধ শিশু, প্রতিবন্ধী মানুষ ও অন্যান্যদের জন্য তিনি নিঃশব্দে বিস্তর দান করে গেছেন। শো-বিজনেসে এখানেই আমি তাঁর সঙ্গে অন্য তারকা ও সেলেব্রিটিদের পার্থক্য দেখতে পাই।’
জনগণের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও নিজের জীবনের শেষ অধ্যায় তিনি আলোকবৃত্তের বাইরেই অতিবাহিত করেছেন। বেশিরভাগ সময়টাই কাটিয়েছেন স্ত্রী সায়রা বানুর সঙ্গে। সায়রা বানুও সুখ্যাত অভিনেত্রী।