০১ অগাস্ট ২০২৫, শুক্রবার, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গডসে আজ ভারতের ‘সুপুত্র’  ‘দেশপ্রেমিক’, আওরঙ্গজেব ও টিপু সুলতান  ‘হানাদার’!

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ১২ জুন ২০২৩, সোমবার
  • / 153

গডসে আজ ভারতের 'সুপুত্র'  'দেশপ্রেমিক', আওরঙ্গজেব ও টিপু সুলতান  'হানাদার'!

আহমদ হাসান ইমরান: ইদানিং আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতা, ফেক নিউজ এবং ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি, জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতার সয়লাব চলছে। তার উপর নির্বাচন সমাগত। সামনেই কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা এবং পরে ২৪-এ লোকসভা নির্বাচন। এতদিন ছিল রামমন্দির।

আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভবের ওপর আঘাত, ভারতে বন্ধ হল রয়টার্সের এক্স অ্যাকাউন্ট

কিন্তু এবার আর অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের হুমকি ও উন্মাদনা আর কাজ করবে না। কারণ, ২০১৯-এ বাবরি মসজিদের জমি সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবং বর্তমানে বিজেপি সাংসদ রঞ্জন গগৈ কথিত হিন্দুপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছেন। গত নির্বাচনে আগে বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং পুলওয়ামাতে ৪০ জন জওয়ানের মর্মান্তিক শহিদ হওয়ার ঘটনাকে বিজেপি খুবই সুচারুভাবে ব্যবহার করেছিল বলে বিরোধীদের অভিযোগ।

আরও পড়ুন: করোনা পরবর্তী ভারতে একাকীত্ব বড় সমস্যা! শহুরে যুবক-যুবতীরা বেশি ভুগছেন একাকীত্বে! রিপোর্টে প্রকাশিত

এবার কিন্তু শাসক দলের হাতে এখনও তেমন কোনও ইস্যু নেই। কিন্তু থিঙ্ক ট্যাঙ্করা তো রয়েছেই। কাজেই ইস্যু বানাতে আর কতক্ষণ, এখন ফের বিভেদকামীদের প্রধান নিশানায় উঠে এসেছে দেশের ২০ কোটি মুসলিম।

আরও পড়ুন: ফ্রান্সের পর প্রথম ভারতে তৈরি হবে ফ্যালকন জেট

পিঞ্চিং, পাঞ্চিং , লিঞ্চিং , কুড়ুল দিয়ে হত্যার ভিডিয়ো সম্প্রচার, কাশ্মীর ফাইলস, কেরালা স্টোরি জাতীয় ভুয়ো গল্পগাথার সিনেমা তৈরি করে ঘৃণা-বিদ্বেষ , ক্রোধ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টাকে সরকার থেকে সহযোগিতা করা, ইতিহাস থেকে মুসলিমদের নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা , শত শত বছর ধরে বিদ্যমান মুসলিম শহর-জনপদ ও রাস্তার নাম পরিবর্তন করে দেওয়া, মুসলিম তরুণদের ‘জঙ্গি’ আখ্যা দিয়ে বিনা বিচারে কিংবা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে বছরের পর বছর কয়েদ করে রাখা ইত্যাদি এখন সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

এবার নতুন করে শুরু হয়েছে নয়া আক্রমণ। আর তা হল যাকে ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলিম সকলেই শ্রদ্ধা করেন সেই টিপু সুলতান এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবকে নিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গালিগালাজ ও ঘৃণা ছড়ানোর সুপরিকল্পিত অভিযান। এই নিয়ে দিন কয়েক আগে কোলহাপুরে একটি দাঙ্গা, হত্যা ও অগ্নিসংযোগেরও ঘটনা ঘটেছে।

যারা ক্ষমতায় থাকবেন তাঁদের সংবিধান অনুসারে শপথ নিতে হয় যে তাঁরা ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে কোনও ধরনের পক্ষপাতিত্ব করবেন না। এখানে দেখা গেল, মহারাষ্ট্রের উপ-মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ অবলীলায় বলে দিলেন, হঠাৎ করে মহারাষ্ট্রে আওরঙ্গজেবের কিছু ‘আওলাদ’ জন্ম নিয়েছে।

এক্ষেত্রেও লক্ষ্য যে মুসলিমরা তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মাঠে নেমেছেন বিজেপির আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং। তিনি বলছেন, ‘গান্ধিজির হত্যাকারী গডসে হচ্ছেন ‘দেশের সুসন্তান’। তাঁর জন্ম ভারতে। তিনি গান্ধিজিকে হত্যা করতে পারেন কিন্তু তিনি এই জাতিরই সন্তান। আওরঙ্গজেব, বাবরের মতো আগ্রাসনকারী ছিলেন না গডসে। বাবরের সন্তান বললে যারা খুশি হয়, তারা ভারতমাতার সন্তান হতে পারে না।’

উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিং বলেছেন, ‘গান্ধি হত্যাকারী গডসে ছিলেন দেশপ্রেমিক।’  উল্লেখ্য, ত্রিবেন্দ্র সিং বিজেপির পদাধিকারী।

স্পষ্টত বোঝা যায়, যে-দলের দায়িত্বশীলরা এসব কথা বলছেন, তাঁরা দেশের সংবিধান, আইন-কানুন, মূল্যবোধ সব কিছুকে ঊল্লঙ্ঘন করছেন। তাঁরা এসব কিছুকে পালটে ফেলতে চান। আর এদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হবে না এবং তাঁদেরকে আইনের আওতায়ও বর্তমানে আনা সম্ভব নয়। কারণ, পুলিশ প্রশাসন তাঁদের পক্ষে নতজানু হয়ে রয়েছে।

সত্যিই কি আওরঙ্গজেব আগ্রাসনকারী হানাদার ছিলেন,  তাঁর জন্মও তো ভারতের মাটিতে। তিনিও তো ভারতের ভূমিপুত্র। আওরঙ্গজেবের আমলেই ভারতবর্ষ প্রকৃত অর্থেই  ‘অখণ্ড ভারতে’ পরিণত হয়েছিল। তাঁর আমলে উপমহাদেশের সীমানা এতটাই বর্ধিত হয়েছিল যে, আগে যেটা কোনও রাজা-মহারাজা বা প্রধানমন্ত্রী করতে পারেননি। ভারতবর্ষে পাঠান ও মোঘলদের কী অবদান রয়েছে, তা গিরিরাজ সিং-এর মতো উগ্রপন্থীদের জানা কিংবা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন।

তাই তিনি ভারতের মহামানবের সাগর তীরে মোঘল-পাঠান, আর্য-অনার্য, হিন্দু, মুসলিম- খ্রিস্টান সবাইকে আহ্বান করেছিলেন। ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী কবিগুরু ব্রাহ্মণদেরও বাদ দেননি। তাঁদেরও তিনি  আহ্বান করেছিলেন। ‘ এসো  হে ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন, হাত ধর সবাকার…’।

তবে ব্রাহ্মণদের প্রতি তাঁর শর্ত ছিল, তাঁদের মনকে শুচি করে আসতে হবে। আর ছোঁয়াছুঁয়ি বাদ দিয়ে সবার হাত ধরতে হবে। কিন্তু আজকের দিনে যখন জাতির জনক, অহিংসার পূজারী গান্ধিজির হত্যাকারী এক উগ্র সন্ত্রাসবাদীকে মহান করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে, তখন রবীন্দ্রনাথের আহ্বান কি এদের কানে যাবে? এরাই তো কবিগুরুর কথায়, ‘বিষাইছে বায়ু’। এদের কীভাবে রবীন্দ্রনাথ ক্ষমা করবেন!

 

 

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

গডসে আজ ভারতের ‘সুপুত্র’  ‘দেশপ্রেমিক’, আওরঙ্গজেব ও টিপু সুলতান  ‘হানাদার’!

আপডেট : ১২ জুন ২০২৩, সোমবার

গডসে আজ ভারতের 'সুপুত্র'  'দেশপ্রেমিক', আওরঙ্গজেব ও টিপু সুলতান  'হানাদার'!

আহমদ হাসান ইমরান: ইদানিং আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতা, ফেক নিউজ এবং ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি, জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতার সয়লাব চলছে। তার উপর নির্বাচন সমাগত। সামনেই কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা এবং পরে ২৪-এ লোকসভা নির্বাচন। এতদিন ছিল রামমন্দির।

আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভবের ওপর আঘাত, ভারতে বন্ধ হল রয়টার্সের এক্স অ্যাকাউন্ট

কিন্তু এবার আর অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের হুমকি ও উন্মাদনা আর কাজ করবে না। কারণ, ২০১৯-এ বাবরি মসজিদের জমি সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবং বর্তমানে বিজেপি সাংসদ রঞ্জন গগৈ কথিত হিন্দুপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছেন। গত নির্বাচনে আগে বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং পুলওয়ামাতে ৪০ জন জওয়ানের মর্মান্তিক শহিদ হওয়ার ঘটনাকে বিজেপি খুবই সুচারুভাবে ব্যবহার করেছিল বলে বিরোধীদের অভিযোগ।

আরও পড়ুন: করোনা পরবর্তী ভারতে একাকীত্ব বড় সমস্যা! শহুরে যুবক-যুবতীরা বেশি ভুগছেন একাকীত্বে! রিপোর্টে প্রকাশিত

এবার কিন্তু শাসক দলের হাতে এখনও তেমন কোনও ইস্যু নেই। কিন্তু থিঙ্ক ট্যাঙ্করা তো রয়েছেই। কাজেই ইস্যু বানাতে আর কতক্ষণ, এখন ফের বিভেদকামীদের প্রধান নিশানায় উঠে এসেছে দেশের ২০ কোটি মুসলিম।

আরও পড়ুন: ফ্রান্সের পর প্রথম ভারতে তৈরি হবে ফ্যালকন জেট

পিঞ্চিং, পাঞ্চিং , লিঞ্চিং , কুড়ুল দিয়ে হত্যার ভিডিয়ো সম্প্রচার, কাশ্মীর ফাইলস, কেরালা স্টোরি জাতীয় ভুয়ো গল্পগাথার সিনেমা তৈরি করে ঘৃণা-বিদ্বেষ , ক্রোধ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টাকে সরকার থেকে সহযোগিতা করা, ইতিহাস থেকে মুসলিমদের নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা , শত শত বছর ধরে বিদ্যমান মুসলিম শহর-জনপদ ও রাস্তার নাম পরিবর্তন করে দেওয়া, মুসলিম তরুণদের ‘জঙ্গি’ আখ্যা দিয়ে বিনা বিচারে কিংবা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে বছরের পর বছর কয়েদ করে রাখা ইত্যাদি এখন সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

এবার নতুন করে শুরু হয়েছে নয়া আক্রমণ। আর তা হল যাকে ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলিম সকলেই শ্রদ্ধা করেন সেই টিপু সুলতান এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবকে নিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গালিগালাজ ও ঘৃণা ছড়ানোর সুপরিকল্পিত অভিযান। এই নিয়ে দিন কয়েক আগে কোলহাপুরে একটি দাঙ্গা, হত্যা ও অগ্নিসংযোগেরও ঘটনা ঘটেছে।

যারা ক্ষমতায় থাকবেন তাঁদের সংবিধান অনুসারে শপথ নিতে হয় যে তাঁরা ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে কোনও ধরনের পক্ষপাতিত্ব করবেন না। এখানে দেখা গেল, মহারাষ্ট্রের উপ-মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ অবলীলায় বলে দিলেন, হঠাৎ করে মহারাষ্ট্রে আওরঙ্গজেবের কিছু ‘আওলাদ’ জন্ম নিয়েছে।

এক্ষেত্রেও লক্ষ্য যে মুসলিমরা তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মাঠে নেমেছেন বিজেপির আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং। তিনি বলছেন, ‘গান্ধিজির হত্যাকারী গডসে হচ্ছেন ‘দেশের সুসন্তান’। তাঁর জন্ম ভারতে। তিনি গান্ধিজিকে হত্যা করতে পারেন কিন্তু তিনি এই জাতিরই সন্তান। আওরঙ্গজেব, বাবরের মতো আগ্রাসনকারী ছিলেন না গডসে। বাবরের সন্তান বললে যারা খুশি হয়, তারা ভারতমাতার সন্তান হতে পারে না।’

উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিং বলেছেন, ‘গান্ধি হত্যাকারী গডসে ছিলেন দেশপ্রেমিক।’  উল্লেখ্য, ত্রিবেন্দ্র সিং বিজেপির পদাধিকারী।

স্পষ্টত বোঝা যায়, যে-দলের দায়িত্বশীলরা এসব কথা বলছেন, তাঁরা দেশের সংবিধান, আইন-কানুন, মূল্যবোধ সব কিছুকে ঊল্লঙ্ঘন করছেন। তাঁরা এসব কিছুকে পালটে ফেলতে চান। আর এদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হবে না এবং তাঁদেরকে আইনের আওতায়ও বর্তমানে আনা সম্ভব নয়। কারণ, পুলিশ প্রশাসন তাঁদের পক্ষে নতজানু হয়ে রয়েছে।

সত্যিই কি আওরঙ্গজেব আগ্রাসনকারী হানাদার ছিলেন,  তাঁর জন্মও তো ভারতের মাটিতে। তিনিও তো ভারতের ভূমিপুত্র। আওরঙ্গজেবের আমলেই ভারতবর্ষ প্রকৃত অর্থেই  ‘অখণ্ড ভারতে’ পরিণত হয়েছিল। তাঁর আমলে উপমহাদেশের সীমানা এতটাই বর্ধিত হয়েছিল যে, আগে যেটা কোনও রাজা-মহারাজা বা প্রধানমন্ত্রী করতে পারেননি। ভারতবর্ষে পাঠান ও মোঘলদের কী অবদান রয়েছে, তা গিরিরাজ সিং-এর মতো উগ্রপন্থীদের জানা কিংবা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন।

তাই তিনি ভারতের মহামানবের সাগর তীরে মোঘল-পাঠান, আর্য-অনার্য, হিন্দু, মুসলিম- খ্রিস্টান সবাইকে আহ্বান করেছিলেন। ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী কবিগুরু ব্রাহ্মণদেরও বাদ দেননি। তাঁদেরও তিনি  আহ্বান করেছিলেন। ‘ এসো  হে ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন, হাত ধর সবাকার…’।

তবে ব্রাহ্মণদের প্রতি তাঁর শর্ত ছিল, তাঁদের মনকে শুচি করে আসতে হবে। আর ছোঁয়াছুঁয়ি বাদ দিয়ে সবার হাত ধরতে হবে। কিন্তু আজকের দিনে যখন জাতির জনক, অহিংসার পূজারী গান্ধিজির হত্যাকারী এক উগ্র সন্ত্রাসবাদীকে মহান করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে, তখন রবীন্দ্রনাথের আহ্বান কি এদের কানে যাবে? এরাই তো কবিগুরুর কথায়, ‘বিষাইছে বায়ু’। এদের কীভাবে রবীন্দ্রনাথ ক্ষমা করবেন!