২০ অগাস্ট ২০২৫, বুধবার, ৩ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অভিশপ্ত করমণ্ডলের কথা ভাবতেই আঁতকে উঠছেন নদিয়ার পরিযায়ী শ্রমিক মুহম্মদ মুহন শেখরা

শফিকুল ইসলাম
  • আপডেট : ৩ জুন ২০২৩, শনিবার
  • / 11

শফিকুল ইসলাম,নদিয়া:

কেউ যাচ্ছিলেন দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসার জন্য। কেউ আবার যাচ্ছিলেন কাজের খোঁজে। কিন্তু, গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই মাঝরাস্তাতেই খেলনা গাড়ির মত ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে যায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস ধাক্কা হয় হামসফর এক্সপ্রেস ও আরও একটি মালগাড়ির সঙ্গে। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় ইতিমধ্যেই প্রায় তিনশো জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত প্রায় হাজার। এই অভিশপ্ত ট্রেনেই ছিলেন নদিয়ার কয়েকজন জন শ্রমিক। কারও বাড়ি নবদ্বীপ থানা এলাকায়,কারও রানাঘাটের হবিবপুর,কারও বাড়ি চাকদহে। তারা জানাচ্ছেন, সকলেই কেরলে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন। কিছুদিন আগেই ফিরেছিলেন বাড়ি। তারপর ফের যাচ্ছিলেন কেরলে। তারমধ্যেই ঘটে যায় এই ঘটনা।

ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় এরা কমবেশি আহত হয়েছেন। শুক্রবার রাতের বিভীষিকাময় সেই স্মৃতি মাথায় নিয়ে কোনওমতে এদিন ঘরে ফিরেছেন সকলে। আহত এই পরিযায়ী শ্রমিকরা দুই দলে ভাগ হয়ে বাড়ি ফেরেন। একটি দল একটি গাড়ি ভাড়া করে গ্রামে আসেন। অন্য দলটি বাস ধরে আহত অবস্থাতেই শালিমার স্টেশনে আসেন। সেখানে থেকে নদিয়ায় আসেন বলে খবর।

গত রাতের স্মৃতি মনে করতে গিয়ে এখনও আঁতকে উঠছেন আহত মুহন শেখ। তিনি জানাচ্ছেন, “বামুনপুকুর চর কাষ্ঠশালি গ্রাম থেকে কেরলে যাচ্ছিলাম। সেখানে আমরা রাজমিস্ত্রির কাজ করি। দুর্ঘটনার পর আমরা সকলেই ট্রেন থেকে ছিটকে পড়ি। একটা ট্রেনের উপর আরও একটা ট্রেন চেপে যায়। কোওমতে আমরা জানলা দিয়ে বেরিয়ে প্রাণে বাঁচি। বাইরে বেরিয়ে দেখি চারদিকে মৃতদেহের স্তূপ। দিকে দিকে আহতদের আর্ত চিৎকার।” এদিকে গ্রামে ফেরার পর প্রথমে তাঁদের নবদ্বীপ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।নবদ্বীপ এদরাকপুরের বুদ্ধদেব ঘোষের অবস্থা স্থিতিশীল।

নবদ্বীপের বামনপুকুর মায়াপুরের চর কাষ্টশালী গ্রামের মুহন শেখ শনিবার বাড়ি ফিরে জানালেন,আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া।আমরা বেঁচে ফিরেছি।বুকে একটু ব্যথা করছে ঠিকই কিন্তু বেঁচে আছি ।একইভাবে  আহত অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসেছেন  প্রসেনজিৎ ঘোষ ও কৃষ্ণঘোষ।তারা হামসফর ট্রেনের যাত্রী ছিলেন।

চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছিলেন কৃষ্ণনগরের সিদ্ধার্থ চাকী,স্ত্রী সোমা চাকী,ও ছেলে আদিত্য চাকী ।তারা করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রী ছিলেন।সুস্থ আছেন।শুক্রবার রাতের বিভীষিকাময় সেই স্মৃতি মাথায় নিয়ে কোনওমতে এদিন ঘরে ফিরেছেন সকলেই।

                                 খোঁজ নেই অনেক পরিযায়ী শ্রমিকের

করমণ্ডল এক্সপ্রেসে যাত্রা করা ছেলের সঙ্গে টানা যোগাযোগের চেষ্টা করে গিয়েছেন নদিয়ার বাসিন্দা সুনীল হালদার। সুনীলের ছেলে নবীন কেরলের পরিযায়ী শ্রমিক। ছুটি কাটিয়ে শুক্রবার করমণ্ডলে চেপে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু শুক্রবার রাতে ট্রেনে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রেন। খবর আসার বেশ কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও নবীনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি তাঁর পরিবার। দুর্ঘটনার খবরে বাড়িতে ভিড় জমাতে শুরু করেছিলেন পড়শি এবং আত্মীয়রাও। এর পর রাত ২টো ৪৫ মিনিট নাগাদ ফোন বেজে ওঠে সুনীলের। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ‘হ্যালো’ বলতেই উল্টো দিক থেকে ভেসে আসে, নবীনের কণ্ঠস্বর। নবীন বলেন, ‘‘বেঁচে আছি বাবা।’’ দীর্ঘ উদ্বেগের পর স্বস্তির ফোনে কান্নায় ভেঙে পড়েন সুনীল।

সুনীল জানিয়েছেন, অন্যের মোবাইল থেকে ফোন করেছিল ছেলে। তার আগে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠাতেই প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা কাটাতে হয়েছিল তাঁদের।

হালদার পরিবারের উদ্বেগ কমলেও এখনও যোগাযোগ করা যায়নি নদিয়ার করিমপুর থেকে কেরলে কাজ করতে যাওয়া চার পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় ফোন হাতে অপেক্ষা করছেন তাঁদের পরিবারও।জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে কেরলে কর্মরত অনেক পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফিরেছিলেন। দিন দশেকের ছুটি কাটিয়ে করমণ্ডলে চেপে কেরল ফিরছিলেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নদিয়ার করিমপুর এলাকার বেশ কয়েক জন পরিযায়ী শ্রমিক। ছিলেন নবীনও।করিমপুর পাটাবুকা এলাকার ৮ জন, লক্ষ্মীপাড়া এলাকার ৩ জন, থানারপাড়া এলাকার ২ জন এবং হুগলবেড়িয়ার ১ জন পরিযায়ী শ্রমিক দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনটিতে ছিলেন। নবীন-সহ আট জনই ছিলেন একই কামরায়। দুর্ঘটনার কারণে গুরুতর আঘাত না পেলেও তাঁরা প্রত্যেকেই চোট পান। দুর্ঘটনার জেরে বেশিরভাগের ব্যাগ খোয়া গিয়েছে। সেই ব্যাগগুলিতেই তাঁদের টাকাপয়সা-সহ যাবতীয় নথি ছিল। সারা রাত স্থানীয় একটি স্কুলে রাত কাটানোর পর এক অটোচালকের সাহায্যে সকাল সাতটা নাগাদ বালেশ্বর স্টেশনে পৌঁছন নবীনরা। প্রাণে বাঁচলেও দুর্ঘটনার ক্ষত, শেষ সম্বল হারানোর যন্ত্রণা, অশক্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরছেন তাঁরা প্রত্যেকে।

নবীনদের খোঁজ পাওয়া গেলেও এখনও খোঁজ মেলেনি নদিয়ার বহু পরিযায়ী শ্রমিকের। ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব না হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে পরিবারের।

 

Tag :

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

অভিশপ্ত করমণ্ডলের কথা ভাবতেই আঁতকে উঠছেন নদিয়ার পরিযায়ী শ্রমিক মুহম্মদ মুহন শেখরা

আপডেট : ৩ জুন ২০২৩, শনিবার

শফিকুল ইসলাম,নদিয়া:

কেউ যাচ্ছিলেন দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসার জন্য। কেউ আবার যাচ্ছিলেন কাজের খোঁজে। কিন্তু, গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই মাঝরাস্তাতেই খেলনা গাড়ির মত ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে যায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস ধাক্কা হয় হামসফর এক্সপ্রেস ও আরও একটি মালগাড়ির সঙ্গে। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় ইতিমধ্যেই প্রায় তিনশো জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত প্রায় হাজার। এই অভিশপ্ত ট্রেনেই ছিলেন নদিয়ার কয়েকজন জন শ্রমিক। কারও বাড়ি নবদ্বীপ থানা এলাকায়,কারও রানাঘাটের হবিবপুর,কারও বাড়ি চাকদহে। তারা জানাচ্ছেন, সকলেই কেরলে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন। কিছুদিন আগেই ফিরেছিলেন বাড়ি। তারপর ফের যাচ্ছিলেন কেরলে। তারমধ্যেই ঘটে যায় এই ঘটনা।

ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় এরা কমবেশি আহত হয়েছেন। শুক্রবার রাতের বিভীষিকাময় সেই স্মৃতি মাথায় নিয়ে কোনওমতে এদিন ঘরে ফিরেছেন সকলে। আহত এই পরিযায়ী শ্রমিকরা দুই দলে ভাগ হয়ে বাড়ি ফেরেন। একটি দল একটি গাড়ি ভাড়া করে গ্রামে আসেন। অন্য দলটি বাস ধরে আহত অবস্থাতেই শালিমার স্টেশনে আসেন। সেখানে থেকে নদিয়ায় আসেন বলে খবর।

গত রাতের স্মৃতি মনে করতে গিয়ে এখনও আঁতকে উঠছেন আহত মুহন শেখ। তিনি জানাচ্ছেন, “বামুনপুকুর চর কাষ্ঠশালি গ্রাম থেকে কেরলে যাচ্ছিলাম। সেখানে আমরা রাজমিস্ত্রির কাজ করি। দুর্ঘটনার পর আমরা সকলেই ট্রেন থেকে ছিটকে পড়ি। একটা ট্রেনের উপর আরও একটা ট্রেন চেপে যায়। কোওমতে আমরা জানলা দিয়ে বেরিয়ে প্রাণে বাঁচি। বাইরে বেরিয়ে দেখি চারদিকে মৃতদেহের স্তূপ। দিকে দিকে আহতদের আর্ত চিৎকার।” এদিকে গ্রামে ফেরার পর প্রথমে তাঁদের নবদ্বীপ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।নবদ্বীপ এদরাকপুরের বুদ্ধদেব ঘোষের অবস্থা স্থিতিশীল।

নবদ্বীপের বামনপুকুর মায়াপুরের চর কাষ্টশালী গ্রামের মুহন শেখ শনিবার বাড়ি ফিরে জানালেন,আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া।আমরা বেঁচে ফিরেছি।বুকে একটু ব্যথা করছে ঠিকই কিন্তু বেঁচে আছি ।একইভাবে  আহত অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসেছেন  প্রসেনজিৎ ঘোষ ও কৃষ্ণঘোষ।তারা হামসফর ট্রেনের যাত্রী ছিলেন।

চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছিলেন কৃষ্ণনগরের সিদ্ধার্থ চাকী,স্ত্রী সোমা চাকী,ও ছেলে আদিত্য চাকী ।তারা করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রী ছিলেন।সুস্থ আছেন।শুক্রবার রাতের বিভীষিকাময় সেই স্মৃতি মাথায় নিয়ে কোনওমতে এদিন ঘরে ফিরেছেন সকলেই।

                                 খোঁজ নেই অনেক পরিযায়ী শ্রমিকের

করমণ্ডল এক্সপ্রেসে যাত্রা করা ছেলের সঙ্গে টানা যোগাযোগের চেষ্টা করে গিয়েছেন নদিয়ার বাসিন্দা সুনীল হালদার। সুনীলের ছেলে নবীন কেরলের পরিযায়ী শ্রমিক। ছুটি কাটিয়ে শুক্রবার করমণ্ডলে চেপে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু শুক্রবার রাতে ট্রেনে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রেন। খবর আসার বেশ কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও নবীনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি তাঁর পরিবার। দুর্ঘটনার খবরে বাড়িতে ভিড় জমাতে শুরু করেছিলেন পড়শি এবং আত্মীয়রাও। এর পর রাত ২টো ৪৫ মিনিট নাগাদ ফোন বেজে ওঠে সুনীলের। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ‘হ্যালো’ বলতেই উল্টো দিক থেকে ভেসে আসে, নবীনের কণ্ঠস্বর। নবীন বলেন, ‘‘বেঁচে আছি বাবা।’’ দীর্ঘ উদ্বেগের পর স্বস্তির ফোনে কান্নায় ভেঙে পড়েন সুনীল।

সুনীল জানিয়েছেন, অন্যের মোবাইল থেকে ফোন করেছিল ছেলে। তার আগে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠাতেই প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা কাটাতে হয়েছিল তাঁদের।

হালদার পরিবারের উদ্বেগ কমলেও এখনও যোগাযোগ করা যায়নি নদিয়ার করিমপুর থেকে কেরলে কাজ করতে যাওয়া চার পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় ফোন হাতে অপেক্ষা করছেন তাঁদের পরিবারও।জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে কেরলে কর্মরত অনেক পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফিরেছিলেন। দিন দশেকের ছুটি কাটিয়ে করমণ্ডলে চেপে কেরল ফিরছিলেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নদিয়ার করিমপুর এলাকার বেশ কয়েক জন পরিযায়ী শ্রমিক। ছিলেন নবীনও।করিমপুর পাটাবুকা এলাকার ৮ জন, লক্ষ্মীপাড়া এলাকার ৩ জন, থানারপাড়া এলাকার ২ জন এবং হুগলবেড়িয়ার ১ জন পরিযায়ী শ্রমিক দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনটিতে ছিলেন। নবীন-সহ আট জনই ছিলেন একই কামরায়। দুর্ঘটনার কারণে গুরুতর আঘাত না পেলেও তাঁরা প্রত্যেকেই চোট পান। দুর্ঘটনার জেরে বেশিরভাগের ব্যাগ খোয়া গিয়েছে। সেই ব্যাগগুলিতেই তাঁদের টাকাপয়সা-সহ যাবতীয় নথি ছিল। সারা রাত স্থানীয় একটি স্কুলে রাত কাটানোর পর এক অটোচালকের সাহায্যে সকাল সাতটা নাগাদ বালেশ্বর স্টেশনে পৌঁছন নবীনরা। প্রাণে বাঁচলেও দুর্ঘটনার ক্ষত, শেষ সম্বল হারানোর যন্ত্রণা, অশক্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরছেন তাঁরা প্রত্যেকে।

নবীনদের খোঁজ পাওয়া গেলেও এখনও খোঁজ মেলেনি নদিয়ার বহু পরিযায়ী শ্রমিকের। ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব না হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে পরিবারের।