দেবিকা মজুমদার: একসপ্তাহ পরেই ঘোষণা হবে লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট এমনটাই খবর কমিশন সূত্রে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের ফুল বেঞ্চ ইতিমধ্যেই রাজ্যে এসে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক, জেলাশাসক এবং অন্যান্য পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে নির্বাচন যাতে সঠিক এবং শান্তিপূর্ণভাবে হয় সেই বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার। নির্বাচনে কোনভাবেই যে হিংসার জায়গা নেই সেই বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
সাধারণভাবে দেশের নির্বাচন কমিশন অন্যতম গণতান্ত্রিক উৎসব নির্বাচনকে যাতে সঠিকভাবে করানো যায় তার জন্য বিভিন্ন নির্দেশ দেয় প্রতিটি রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকদের এবং সেই মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকরা সেই নির্দেশকে জেলা শাসক বা জেলা নির্বাচনী আধিকারিকদের পাঠান। দেখা যায়, সবশেষে সেই নির্দেশকে পালন করার জন্য জেলাশাসকরা নিজেদের নাওয়া খাওয়া ভুলে শান্তিপূর্ণভাবে কিভাবে নির্বাচনকে করানো যায় বা সেই নির্দেশকে কতটা দ্রুত পালন করা যায় সেই বিষয়টিতেই একমাত্র মনোনিবেশ করেন।
শুধু নির্বাচন নয়, নির্বাচন ছাড়াও জেলা শাসকদের কাঁধে একটি সম্পূর্ণ জেলার অন্যান্য সব দায়িত্ব থাকে। মাথা ঠান্ডা রেখে, মুখে হাসি নিয়ে কিভাবে জেলাশাসকরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশকে পালন করবেন তার জন্য দৈনন্দিন জীবনকে এখন থেকেই ভুলে গিয়েছেন তাঁরা।
এমনই এক জেলাশাসক হলেন পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক তানভীর আফজল। পুবের কলমকে দেওয়া এক টেলিফোনিক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, জেলাশাসক হিসেবে কাজ করা মনে এমনিতেই পারিবারিক জীবন বলে কিছু থাকে না। আমাকে কাজের সূত্রে পরিবারের থেকে আলাদা থাকতে হয়। আমার মেয়ে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। নিটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার সঙ্গে দেখা করে যায়। সবসময় জেলার কাজ চলছে। ছুটির দিনেও আমাদের কাজের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। সামনে নির্বাচন। তাই সবার ছুটির দিনেও আমার জিরোনোর সময় নেই। নির্বাচন থাকলে এমনিতেই কাজের চাপ দশগুণ বেড়ে যায়। আর এখন তো সারাবছরই কিছু না কিছু নির্বাচনের কাজ চলছেম এছাড়া ভোটার লিস্ট আপডেট করার থাকে। যে বছর ভোট থাকে সেবছর ভোটার লিস্টের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে কাজ করতে আমরা প্রস্তুত থাকি। জামিন অযোগ্য পরোয়ানা শূন্য করার যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেই নির্দেশ মেনে আমরা তিন মাসের মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুরে প্রায় ৬ হাজার জামিন অযোগ্য পরোয়ানার মীমাংসা করেছি। বাকি আছে আরও প্রায় ১৯০০ মামলা। ২০২১ সালেও ভোটের আগে এত সংখ্যক জামিন অযোগ্য পরোয়ানার মীমাংসা করা যায়নি। আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
ঝাড়গ্রাম জেলার জেলাশাসক সুনীল আগরওয়াল পুবের কলমকে জানান, সারাবছরই কাজের চাপ খুব বেশি থাকে। নির্বাচন আসলে সেই চাপ আরো বেড়ে যায়। ভোটার তালিকা থেকে শুরু করে ইভিএম সব দিকে সমান ভাবে নজর দিতে হয়। কোথাও একটু ভুল হলে চলবে না। একেবারে একশো শতাংশ নিখুঁত হতে হবে। এই সবের মাঝে পরিবারকে সময় একেবারেই দেওয়া যায় না। এর মধ্যেই নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনেই সমস্ত কাজ করে চলেছি। ইতিমধ্যেই আমার রাজ্যে প্রায় পাঁচ হাজার জামিন অযোগ্য পরোয়ানার মীমাংসা করা গেছে। বাকি রয়েছে আরো পাঁচশ’ থেকে ছয়শ’ মামলা। যা খুব শীঘ্রই মিটিয়ে ফেলা হবে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, বীরভূমের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজি জানান, সব কাজই করতে হয়। কাজের চাপ তো থাকেই। তবে এটা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই।
রাজ্যে আশি হাজারের বেশি বুথে নির্বাচনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য ইতিমধ্যেই জেলাশাসকদের ঘুম ছুটেছে। কারণ পান থেকে চুন খসলেই হাত পড়বে মাথায়। এর পেছনে অনেকগুলি কারণ আছে। একদিকে রাজ্যের শাসক দল তার সঙ্গে অনেকগুলো বিরোধী রাজনৈতিক দল। এদের প্রত্যেকেরই অভাব অভিযোগ প্রতি মুহূর্তে ঠান্ডা মাথায় শুনে তাকে সঠিকভাবে আইন মোতাবেক বিচার করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। পাশাপাশি একদিকে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অন্যদিকে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দপ্তরের নির্দেশ। অগত্যা কোন উপায় নেই সেই ছোট্ট মাথাটার মধ্যেই সবকিছুকে নিয়ে চলতে হচ্ছে ভারসাম্য বজায় রেখেই। আর এমতবস্থায় নিজের পরিবার পরিজন থেকে শুরু করে আর আত্মীয়-স্বজন, একটা কথা বলার ও সময় থাকে না এমনকি একটা ফোন করে খোঁজ নেওয়ারও সময় থাকে না অনেকসময়। আর খাওয়া দাওয়া ঘুম থেকে শুরু করে প্রতিদিনই নিজের যে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা তাও এখন থেকেই শিকেয় উঠেছে। এদিকে, ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিরোধীদল থেকে শুরু করে শাসকদল এমনকি সাধারণ মানুষ যথারীতি সেই বদনামের বোঝা নিয়ে হাজির। অথচ সেই জেলাশাসক কিন্তু নিজের কাজে এতটাই অবিচল যে সাধারণ মানুষের এত কটু মন্তব্যের পরেও একদিকে কমিশন অন্যদিকে শাসক দল আরেক পাশে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দপ্তর আর সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দল সকলের মন জুগিয়ে চলছেন। সবাই শুধু বোঝে নিজের জায়গাটাই কিন্তু একবারের জন্যও কেউ এই জেলাশাসকদের কথাটা ভাবেনা।
যদিও রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানাচ্ছেন, আমাদের কোনও কিছু করার উপায় নেই তার কারণ আইনের খাতায় আমরা প্রত্যেকেই একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে আছি। তাই কমিশনের নির্দেশকে আমাদের পালন করতে হবেই অন্যথা নিজের সুনাম নিজের কাজ সবকিছু থেকে আমাদের সরে যেতে হবে। এত বছর ধরে এত কষ্ট করে রাত জেগে পড়াশোনা করে, আজ জেলাশাসকরা নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে শিরোধার্য হয়ে উঠেছেন। এক কথায় মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দপ্তর মূলত ডাক বাবুর কাজটা করে। আদতে মাঠে নেমে ময়দানে নেমে নিজের গতর খাটিয়ে কমিশনের নির্দেশকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যিনি পালন করে চলেন তিনিই জেলা শাসক। মানুষ একবার তো অন্তত ভাবুক যে কেবলমাত্র এই নির্বাচনের সময় তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ থেকে শুরু করে তার নিজের জেলায় অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট করাতে কতটা বদ্ধপরিকর এই জেলাশাসক। আর কবে ভাববেন আপনারা? তার কারণ মানুষ তো আপনিও মানুষ আমরা সকলেই, অযথা অকারণে একজন জেলাশাসকের দিকে অঙ্গুলি নিক্ষেপ করার আগে একটু ভেবে দেখুন। আপনার মতন কি তিনিও জীবন যাপন করতে পারছেন?