নববর্ষ: বাঙালিয়ানার নবজাগরণের শপথ

- আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার
- / 87
বঙ্গাব্দের উৎপত্তি মুঘল সম্রাট আকবরের সময় হলেও, এটি বহু শতাবব্দী ধরে বাঙালি জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। হালখাতা ও নববর্ষ বাঙালির আত্মপরিচয়ের উৎসব। ভাষা ও সংস্কৃতিই বাঙালির প্রধান পরিচয়, যা নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক স্বতন্ত্র চরিত্র ধারণ করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর উত্থানের পর আজ বাঙালি সংস্কৃতি নানা চাপে নত হলেও, বাংলাদেশ একটি আশার প্রতীক। পহেলা বৈশাখ শুধু উৎসব নয়, বরং বাঙালিয়ানা ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের শপথের দিন। নতুন চিন্তা ও সৃজনশীলতাই বাঙালিকে আবার জাগিয়ে তুলতে পারে। লিখেছেন মনিরুল ইসলাম
বাঙালি জীবনে পয়লা বৈশাখ (Pohela Boishakh) এক আত্মপরিচয়ের প্রতীক। বঙ্গাব্দের সূচনা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও এর প্রভাব গ্রামীণ জীবন, হিন্দু ধর্মীয় আচার, মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান ও বাংলার সামগ্রিক সংস্কৃতিতে অনস্বীকার্য। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠান, যেখানে পুরোনো দেনা-পাওনার হিসাব মিটিয়ে নতুন খাতা খোলা হয়, তা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে একটি সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। যদিও আধুনিক ব্যাঙ্কিং ও ডিজিটাল লেনদেন এই রীতিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে, তবু বাংলা নববর্ষ বাঙালির আত্মিক চেতনার একটি অনন্য দিন হিসেবে টিকে আছে।
বঙ্গাব্দের ইতিহাসে উঠে আসে মুঘল সম্রাট আকবরের নাম। তিনি চান যে হিজরি সনের ধর্মীয় গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে কৃষিকাজ ও রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে একটি সৌরভিত্তিক ক্যালেন্ডার তৈরি করা হোক। তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ শিরাজি ইলাহী সন তৈরি করেন, যার আদলে বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। যদিও কার্যকর সময় নিয়ে বিতর্ক আছে, তবু অধিকাংশ ঐতিহাসিক একমত যে, আকবর-যুগেই বঙ্গাব্দের গোড়াপত্তন।
বাংলা সন (Pohela Boishakh) প্রবর্তনে মুসলমান ও হিন্দু উভয় ধর্মে প্রভাব পড়ে। বাংলা সন ছাড়াও প্রায় সকল সনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রভাবের একটি দিক থাকে। বাংলা সনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিমের মিলিত স্রোতে সনটি অসাম্প্রদায়িক অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে যা উদার ইসলামী সংস্কৃতির পাশাপাশি বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থেই এ সন প্রবর্তন হয়েছিল।
বাংলা সন শুধু একটি সময় গণনার পদ্ধতি নয়, বরং বাঙালির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার প্রতীক। প্রাচীন বাংলার পুণ্ড্র, গৌড়, বরেন্দ্র, রাঢ়, সমতট, বঙ্গ প্রভৃতি জনপদের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারায়, ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়ে গড়ে উঠেছে বাঙালি জাতি। অধ্যাপক আহমদ শরীফ যথার্থই বলেন, বাঙালিত্ব একটি আধুনিক জাতিসত্তা, যা গঠিত হয়েছে বহু ধারার সংমিশ্রণে।
বাংলা সন (Pohela Boishakh) প্রবর্তন থেকেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে এ সনের পরিচয় সুগভীর। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হলে আজ বাংলা কত তারিখ, তারা হাতের আঙ্গুলে গুণে তা বলে দেবেন। গ্রামের মানুষের কাছে বাংলা সনের পর গুরুত্ব হচ্ছে হিজরি সন। বাংলা সন প্রবর্তনের বছর থেকেই জমির খাজনা পরিশোধ করা হচ্ছে। এ নিয়মই আজও পর্যন্ত বিদ্যমান। ইংরেজ শাসনামল অবসানের পর কালক্রমে ‘নববর্ষ’ উদযাপন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
চৌদ্দ শতকের মধ্যে বাংলার নিজস্ব ভাষা, লিপি, খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক একটি স্বতন্ত্র রূপ ধারণ করে। মহীপালকে বাঙালির প্রথম রাষ্ট্রীয় শাসক হিসেবে ধরা যায়। এরপর তুর্কি অভিযান (১২০৪), আকবরের সুবা বাংলা গঠন (১৫৭৬), পলাশির যুদ্ধ (১৭৫৭), বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫), দেশভাগ (১৯৪৭) এবং বাংলাদেশের জন্ম (১৯৭১)— এইসব ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে গড়ে ওঠে বাঙালির একটি জাতিগত চেতনা।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা হয়ে ওঠে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্র। ইংরেজি শিক্ষায় বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান তাকে সারা ভারতেই নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছিল। কিন্তু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের পর রাজধানী দিল্লিতে সরে যাওয়ায় ধীরে ধীরে কলকাতার কৌলীন্য ম্লান হতে থাকে। আজকের দিনে সেই বাঙালি সংস্কৃতি হিন্দি প্রভাবিত উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির সামনে পড়ে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
বাংলার রাজনৈতিক কাঠামোও পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় শিল্প, শিক্ষা, সাহিত্য ও বাণিজ্যের দিক দিয়ে শক্তিশালী বাংলা এখন প্রান্তিক রাজ্যে পরিণত। কেন্দ্রীয় নির্ভরতা ও সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাসের সংকট এক গভীর দুঃসময় ডেকে এনেছে। এর সঙ্গেযুক্ত হয়েছে বেকারত্ব, শিল্পহীনতা ও অনুন্নয়নের এক কঠিন বাস্তবতা, যা বাঙালিকে ক্রমাগত পিছিয়ে দিচ্ছে। তবু আশার আলো নিভে যায়নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র আজ বাঙালিয়ানার এক স্বাধীন আশ্রয়। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির অসামান্য মেধা, সৃজনশীলতা এবং সাংস্কৃতিক অবদানই প্রমাণ করে— বাঙালি এখনও জাগতে পারে, জয় করতে পারে।
আজকের বাংলা নববর্ষ (Pohela Boishakh) হোক সেই নবজাগরণের শপথের দিন। এদিন কেবলমাত্র নতুন পোশাক বা ভোজন-বিনোদনের দিন নয়— এ এক আত্মসংশোধনের দিন। নতুন করে ভাবার, নতুন করে সৃষ্টির, এবং একান্তভাবে নিজের সাংস্কৃতিক শিকড়ে ফিরে যাওয়ার দিন। ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে এই দিনটিকে একটি সার্বজনীন সাংস্কৃতিক চেতনার উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই আজ সময়ের দাবি।সমস্ত হতাশা থেকে কাটি উঠে,আলোকপাতের দিশারী হতে পারে নতুন প্রজন্মের হাত ধরে সৃজনশীল চিন্তাভাবনা।
আসুন, নববর্ষে (Pohela Boishakh) আমরা শপথ নিই— ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে অবলম্বন করে এক নবচেতনার বাঙালি জাতি গড়ে তোলার। পহেলা বৈশাখ হোক বাঙালিয়ানার পুনর্জাগরণের দিন। এই আত্মবিশ্বাস, এই মনন ও সংস্কৃতির শক্তিতেই আমরা নতুন পথের দিশা খুঁজে নেব।