০৪ অগাস্ট ২০২৫, সোমবার, ১৯ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পহেলা বৈশাখে এপারে ‘মঙ্গল’ আর ওপারে ‘আনন্দ’

সুস্মিতা
  • আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার
  • / 314

আহমদ হাসান

বর্ষবরণ এপার বাংলা ওপার বাংলা এবং মধ্যিখানে ত্রিপুরা, অসম, ঝাড়খন্ডের বাঙালিদের কাছে একটি বড় উৎসব। বলা যায় একমাত্র সেক্যুলার উৎসব। কিন্তু তার মধ্যেও রাজনীতি, সাংস্কৃতিক আধিপত্য এবং ধর্মীয় অনুসঙ্গের মিশেল দেওয়ার চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে।

বাংলাদেশ এবারে নববর্ষ উৎসবের নাম পরিবর্তন হয়ে গেছে। এতদিন ধরে (শুরু ১৯৮৯ সালে) বর্ষবরণের শোভাযাত্রার নাম ছিল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এতে থাকত নানা রকমের মুখোশ যেমন- পেঁচা, ঘোড়ার প্রথম অংশ, দানবাকৃতির কিছু মুখোশ ইত্যাদি। এই উৎসবে হাসিনা সরকারের এবং উগ্র সেক্যুলার কিছু মিডিয়ার সমর্থন থাকত। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনগণ মুসলিমদের অনেকেরই বক্তব্য ছিল, মঙ্গল শোভাযাত্রায় ইসলামের কোনও অনুসঙ্গ নেই। বরং রয়েছে বিজাতীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। আর মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে অশুভ শক্তি দূরীভূত হবে, এ কোনও মতেই বাঙালি মুসলিম জনগণের বিশ্বাস নয়। এ নিয়ে দুই পক্ষে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই দেখা গেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। বাংলাদেশের সেক্যুলার সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচিও জড়িয়ে পড়ে এই দ্বন্দ্বে। যারা এই মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে সামান্য কথা বলত, তাদের মৌলবাদী, বাঙালি সংস্কৃতি বিরোধী, উগ্রপন্থী বলে দেগে দেওয়ার একটি শক্তিশালী প্রবণতা ছিল ঢাকায়। অন্য পক্ষের বক্তব্য ছিল, বাঙালি আগে পহেলা বৈশাখে হালখাতা করত। গ্রামের দিকে চাষবাসের শুরুকে কেন্দ্র করে নবান্ন প্রস্তুত হত। কোথাও কোথাও আবার মিলাদও পাঠ করা হত। এই ঐতিহ্য এখনও রয়ে গেছে এপার বাংলায়। বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে। আর ঢাকায় এ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হত যে, বাঙালি সংস্কৃতিতে এপার বাংলার হিন্দুদেরই অগ্রণী মনে করা হয়। কই তারা তো ‘অমঙ্গল’ দূর করার জন্য কখনই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করেন না! দু-একবার অবশ্য এপার বাংলায় যে চেষ্টা হয়নি, তা নয়। কিন্তু সেই চেষ্টা সম্প্রসারিত হতে তো পারেইনি, বরং তার অকাল মৃত্যু হয়েছে।

আরও পড়ুন: বাংলার হজ আবেদনকারীদের সংখ্যা ২০২৬-এ আরও কমে যাচ্ছে

আরও পড়ুন: নববর্ষ: বাঙালিয়ানার নবজাগরণের শপথ

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে স্টারলিংক চালু

হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে এই প্রথম বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হতে চলেছে। যে করেই হোক বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে ‘আওয়ামি লিগের ফ্যাসিবাদী শাসন’ ও জুলুমকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা মোস্তাফা সরোয়ার ফারুকী প্রথম প্রস্তাব রাখেন, জনবিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের নাম পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। এ নিয়ে আওয়ামিপন্থীরা আপত্তি তোলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, যেখান থেকে ঢাকায় প্রধান শোভাযাত্রা বের হয় সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শোভাযাত্রার নাম রাখা হয়েছে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। আর খুবই ধুমধামের সঙ্গে বাংলাদেশে রমনার বটমূল থেকে শুরু করে সব জায়গায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান নাচ, গান, আবৃত্তির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকার আকাশে ছিল চিন দূতাবাসের দেওয়া ড্রোনের আলোক সজ্জার নজির বিহীন প্রদর্শনী। মানবজমিনের দু’টি হেডিং হচ্ছে ‘এবারের মূল আকর্ষণ ফ্যাসিবাসের মুখাকৃতি’ ও ‘নববর্ষের ঐকতান ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্যে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।

আরও পড়ুন: ‘July uprising anniversary’: স্বৈরাচার যেন আর মাথাচাড়া দিতে না পারে: প্রধান উপদেষ্টা

তবে এপার বাংলা বর্ষবরণে পুনরায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ঢাকায় বন্ধ হলেও কলকাতায় এবার ঢাকঢোলের সঙ্গেই হবে মঙ্গলবার ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ বিকেল ৪টে থেকে এই শোভাযাত্রা বের করবে। এই সংগঠনটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএস-এর অনুসারিদের দ্বারা তৈরি। এই শোভাযাত্রা ঢাকার পুরাতন মঙ্গল শোভাযাত্রার থেকে কিছুটা আলাদা। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ভট্টাচার্য বলেছেন, ঢাকার মিছিলে যে সাপ, পেঁচা, বাদুড় ইত্যাদি প্রতিকৃতি থাকে আমরা বাঙালির মঙ্গলের চিরন্তন প্রতীক নিয়ে বর্ষবরণ করব। এই প্রতীকগুলি হচ্ছে লজ্জা গৌরি, মঙ্গল ঘট, চামর শোভাযাত্রায় থাকবে। শঙ্খ ধ্বনি-সহ শোভাযাত্রা চলবে, কীর্তনের দলও থাকবে। আর থাকবে ব্রাহ্মন্য সংস্কৃতির প্রতীক গৌড়াধিপতি রাজাধিরাজ শশাঙ্কের বেশধারী এক ঘোরসওয়ার। মোদিজির অধিনস্থ সংস্কৃতি মন্ত্রকের পূর্বাচল সংস্কৃতি কেন্দ্র এই শোভাযাত্রাকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, এই শোভাযাত্রায় থাকবে হিন্দুয়ানির বাড়বাড়ন্ত। তা থাকুক। ওপারের আনন্দকে আমরা এপারে যে মঙ্গল দিয়ে টেক্কা দিতে পারব, তাতে কিন্তু সন্দেহ নেই।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

পহেলা বৈশাখে এপারে ‘মঙ্গল’ আর ওপারে ‘আনন্দ’

আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার

আহমদ হাসান

বর্ষবরণ এপার বাংলা ওপার বাংলা এবং মধ্যিখানে ত্রিপুরা, অসম, ঝাড়খন্ডের বাঙালিদের কাছে একটি বড় উৎসব। বলা যায় একমাত্র সেক্যুলার উৎসব। কিন্তু তার মধ্যেও রাজনীতি, সাংস্কৃতিক আধিপত্য এবং ধর্মীয় অনুসঙ্গের মিশেল দেওয়ার চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে।

বাংলাদেশ এবারে নববর্ষ উৎসবের নাম পরিবর্তন হয়ে গেছে। এতদিন ধরে (শুরু ১৯৮৯ সালে) বর্ষবরণের শোভাযাত্রার নাম ছিল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এতে থাকত নানা রকমের মুখোশ যেমন- পেঁচা, ঘোড়ার প্রথম অংশ, দানবাকৃতির কিছু মুখোশ ইত্যাদি। এই উৎসবে হাসিনা সরকারের এবং উগ্র সেক্যুলার কিছু মিডিয়ার সমর্থন থাকত। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনগণ মুসলিমদের অনেকেরই বক্তব্য ছিল, মঙ্গল শোভাযাত্রায় ইসলামের কোনও অনুসঙ্গ নেই। বরং রয়েছে বিজাতীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। আর মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে অশুভ শক্তি দূরীভূত হবে, এ কোনও মতেই বাঙালি মুসলিম জনগণের বিশ্বাস নয়। এ নিয়ে দুই পক্ষে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই দেখা গেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। বাংলাদেশের সেক্যুলার সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচিও জড়িয়ে পড়ে এই দ্বন্দ্বে। যারা এই মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে সামান্য কথা বলত, তাদের মৌলবাদী, বাঙালি সংস্কৃতি বিরোধী, উগ্রপন্থী বলে দেগে দেওয়ার একটি শক্তিশালী প্রবণতা ছিল ঢাকায়। অন্য পক্ষের বক্তব্য ছিল, বাঙালি আগে পহেলা বৈশাখে হালখাতা করত। গ্রামের দিকে চাষবাসের শুরুকে কেন্দ্র করে নবান্ন প্রস্তুত হত। কোথাও কোথাও আবার মিলাদও পাঠ করা হত। এই ঐতিহ্য এখনও রয়ে গেছে এপার বাংলায়। বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে। আর ঢাকায় এ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হত যে, বাঙালি সংস্কৃতিতে এপার বাংলার হিন্দুদেরই অগ্রণী মনে করা হয়। কই তারা তো ‘অমঙ্গল’ দূর করার জন্য কখনই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করেন না! দু-একবার অবশ্য এপার বাংলায় যে চেষ্টা হয়নি, তা নয়। কিন্তু সেই চেষ্টা সম্প্রসারিত হতে তো পারেইনি, বরং তার অকাল মৃত্যু হয়েছে।

আরও পড়ুন: বাংলার হজ আবেদনকারীদের সংখ্যা ২০২৬-এ আরও কমে যাচ্ছে

আরও পড়ুন: নববর্ষ: বাঙালিয়ানার নবজাগরণের শপথ

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে স্টারলিংক চালু

হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে এই প্রথম বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হতে চলেছে। যে করেই হোক বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে ‘আওয়ামি লিগের ফ্যাসিবাদী শাসন’ ও জুলুমকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা মোস্তাফা সরোয়ার ফারুকী প্রথম প্রস্তাব রাখেন, জনবিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের নাম পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। এ নিয়ে আওয়ামিপন্থীরা আপত্তি তোলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, যেখান থেকে ঢাকায় প্রধান শোভাযাত্রা বের হয় সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শোভাযাত্রার নাম রাখা হয়েছে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। আর খুবই ধুমধামের সঙ্গে বাংলাদেশে রমনার বটমূল থেকে শুরু করে সব জায়গায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান নাচ, গান, আবৃত্তির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকার আকাশে ছিল চিন দূতাবাসের দেওয়া ড্রোনের আলোক সজ্জার নজির বিহীন প্রদর্শনী। মানবজমিনের দু’টি হেডিং হচ্ছে ‘এবারের মূল আকর্ষণ ফ্যাসিবাসের মুখাকৃতি’ ও ‘নববর্ষের ঐকতান ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্যে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।

আরও পড়ুন: ‘July uprising anniversary’: স্বৈরাচার যেন আর মাথাচাড়া দিতে না পারে: প্রধান উপদেষ্টা

তবে এপার বাংলা বর্ষবরণে পুনরায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ঢাকায় বন্ধ হলেও কলকাতায় এবার ঢাকঢোলের সঙ্গেই হবে মঙ্গলবার ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ বিকেল ৪টে থেকে এই শোভাযাত্রা বের করবে। এই সংগঠনটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএস-এর অনুসারিদের দ্বারা তৈরি। এই শোভাযাত্রা ঢাকার পুরাতন মঙ্গল শোভাযাত্রার থেকে কিছুটা আলাদা। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ভট্টাচার্য বলেছেন, ঢাকার মিছিলে যে সাপ, পেঁচা, বাদুড় ইত্যাদি প্রতিকৃতি থাকে আমরা বাঙালির মঙ্গলের চিরন্তন প্রতীক নিয়ে বর্ষবরণ করব। এই প্রতীকগুলি হচ্ছে লজ্জা গৌরি, মঙ্গল ঘট, চামর শোভাযাত্রায় থাকবে। শঙ্খ ধ্বনি-সহ শোভাযাত্রা চলবে, কীর্তনের দলও থাকবে। আর থাকবে ব্রাহ্মন্য সংস্কৃতির প্রতীক গৌড়াধিপতি রাজাধিরাজ শশাঙ্কের বেশধারী এক ঘোরসওয়ার। মোদিজির অধিনস্থ সংস্কৃতি মন্ত্রকের পূর্বাচল সংস্কৃতি কেন্দ্র এই শোভাযাত্রাকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, এই শোভাযাত্রায় থাকবে হিন্দুয়ানির বাড়বাড়ন্ত। তা থাকুক। ওপারের আনন্দকে আমরা এপারে যে মঙ্গল দিয়ে টেক্কা দিতে পারব, তাতে কিন্তু সন্দেহ নেই।