০১ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মুখ খোলা কিন্তু মাথায় হিজাব কেন! কনস্টেবল নিয়োগের পরীক্ষা দিতে পারবে না কিছু তরুণী

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, বুধবার
  • / 11

মুর্শিদাবাদ থেকে আসা তুহিনা খাতুন। ডানদিকে সোনামণি খাতুনের আবেদনপত্র।

রফিকুল ইসলামঃ চাকরির বাজার তো সকলেই জানেন। সেই হিসেবে যখন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড ২০২০ সালে কনস্টেবল ও লেডি কনস্টেবল নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়– স্বাভাবিকভাবেই কয়েক লক্ষ তরুণ-তরুণী তাতে আবেদন করে। এখন নিয়োগ পরীক্ষা হবে ২৬ সেপ্টেম্বর।
বর্তমানে চলছে অ্যাডমিট কার্ড সংগ্রহের পালা। সোমবার অন্য বেশ কিছু প্রার্থীর সঙ্গে ১০-১২ জন মুসলিম তরুণীকেও দেখা যায় বিধাননগরের ওয়েস্টবেঙ্গল পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের অফিসে হাজির হতে। তাদের মধ্যে গ্রামবাংলার দূরবর্তী অঞ্চলের তরুণীরাও রয়েছে। তাদের সকলেরই একই বক্তব্য। তারা সঠিকভাবে আবেদনপত্র জমা দিলেও তাদের অ্যাডমিট কার্ড ডাউনলোড করা যাচ্ছে না। সোমবার যে মুসলিম তরুণীরা বিধাননগরের ওয়েস্টবেঙ্গল পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের হেড কোয়ার্টাসে হাজির ছিল– তাদের মধ্যে ছিল সুমাইয়া ইয়াসমিন– হরিহরপাড়া– মুর্শিদাবাদ– সোনামনি খাতুন– দেগঙ্গা– উত্তর ২৪ পরগনা– তুহিনা খাতুন– বেলডাঙা– মুর্শিদাবাদ– ফিরদৌসি খাতুন– মুর্শিদাবাদ– সারিকা পারভিন খাতুন– নদীয়া প্রমুখ।
এই তরুণীরা শান্তভাবে জানার চেষ্টা করে– কেন তাদের অ্যাডমিট কার্ড ডাউনলোড যাচ্ছে না। কারণ তারা প্রত্যেকেই পরীক্ষা ফি বাবদ ধার্য ১৭০ টাকা দিয়েছে। ওবিসিদের পুরো ১৭০ টাকাই দিতে হয়েছে। এসসি ও এসটিরা অবশ্য দিয়েছে মাত্র ২০ টাকা করে। কিন্তু বোর্ডেকে তাদের অভিযোগের জবাব দেবে? রিসেপশন থেকে বলে দেওয়া হয়– যে আধিকারিকরা তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন তাঁরা উপরের তলাগুলিতে বসেন। কিন্তু যে সমস্যা বা অভিযোগ নিয়ে তারা এসেছে তার ভিত্তিতে তাদের উপরের তলায় পাঠানো যাবে না।
অনেক কথাবার্তা– মিনতির পর ওখানে উপস্থিত কয়েকজন কনস্টেবল তাদের জানান– ছবিতে তাদের মুখ খোলা থাকলেও কানের পাশ দিয়ে তাদের মাথা ঢাকা রয়েছে। ‘এদের মধ্যে একজনের মুখ খোলা ছিল– মাথা শুধু শাড়ি দিয়ে ঢাকা ছিল’।
এই তরুণীরা পুবের কলম-কে বলে– আমরা ধর্মীয় কারণে মাথা আবৃত করে রেখেছিলাম। মুখ ছিল পুরো খোলা। সুমাইয়া ইয়াসমিন বলে– হিজাব পরার ধর্মীয় অধিকার সংবিধান আমাকে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড কিভাবে নিয়ম করল যে– মুসলিম মেয়েদের মাথাও পুরোপুরি উন্মুক্ত রাখতে হবে? অন্যদিকে দেগঙ্গার সোনামনির একই বক্তব্য।
এই তরুণীরা পুবের কলমকে বলে– সবথেকে দুঃখ লাগছে কোনও একজনও পুলিশ আধিকারিকও আমাদের বক্তব্য শোনার প্রয়োজন বোধ করলেন না। পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ তো জনগণের বন্ধু। তাদের তো আমাদের বক্তব্য শোনা উচিত। উচ্চস্তরে আমাদের কথা পৌঁছে দেওয়া উচিত। আর যখন মাথা ঢাকা চলবেই না– তখন তারা কেন মাথা ঢাকা অবস্থায় আমাদের ছবি তুললেন এবং ১৭০ টাকা করে জমা নিলেন? এক পর্যায়ে বিধাননগর থানা থেকে পুলিশ এনে সেখানে জমায়েত অ্যাডমিট কার্ড প্রার্থীদের লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করে। বলে এখানে বেশিক্ষণ থাকলে গ্রেফতার করে নিয়ে যাব।
এ সম্পর্কে সেখানে উপস্থিত একজন প্রার্থীর বাবা (যিনি একটি মসজিদের ইমাম) বললেন– ভারত তো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, তাহলে যেটা আমাদের ধর্মচারণের অঙ্গ– তার জন্য আমাদের বঞ্চিত করা ঠিক নয়। আমার মেয়ে বড় আশা করে এসেছিল পুলিশে চাকরি করে সে সমাজের সেবা করবে!
পুবের কলম-এর প্রতিনিধি জানতে পেরেছেন– এখন প্রত্যেকদিনই ৬-৭ জন করে মুসলিম তরুণী তাদের এই সমস্যা নিয়ে বিধাননগর পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে উপস্থিত হচ্ছে। অনেকে বলছেন– যদি বিকল্প কোনও ব্যবস্থা থাকে তাহলে তার মাধ্যমেই মুসলিম তরুণীদের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। প্রয়োজনে দ্বিতীয়বার ছবি তুলে তাদের অ্যাডমিট কার্ডে সংযুক্ত করা হোক।
বিশিষ্ট সমাজসেবী নইম শেখ-এর মত হচ্ছে– ‘সিপিএম আমলে বলা হত মুসলিম তরুণীরা চাকরির জন্য ঘর থেকে বের হয় না। কাজেই চাকরি পাবে কি করে? এখন কিন্তু ঘর থেকে বের হলেও মুসলিম হিসেবে তারা নানা অজুহাতে চাকরি পায় না। তিনি আরও বলেন– শিখরা তো মাথায় পাগড়ি ও লম্বা চুল-দাড়ি নিয়ে আর্মিতেও জেনারেলের চাকরি পাচ্ছেন। যাই হোক হয়তো বা ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম রয়েছে!’ স্থানীয় একজন তৃণমূল নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন– ‘মুসলিম তরুণীদের এই বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর নজরে না আনলে এই সমস্যার সমাধান দ্রুত করা যাবে না।’
দ্বিতীয় আর একটি সমস্যা রয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছেন– টেকনিক্যাল কারণে কয়েক হাজার প্রার্থীর অ্যাডমিট কার্ড ডাউনলোড করা যাচ্ছে না। এর জন্য দায়ি কিন্তু কম্পিউটার বা সফটওয়্যারের ত্রুটি।
২৬ সেপ্টেম্বরের পরীক্ষায় পাশ করলে ৮–৮০০ জন তরুণ-তরুণী কনস্টেবলে চাকরি পাবে।
অতিরিক্ত তথ্যঃ মফিকুল ইসলাম

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

মুখ খোলা কিন্তু মাথায় হিজাব কেন! কনস্টেবল নিয়োগের পরীক্ষা দিতে পারবে না কিছু তরুণী

আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, বুধবার

রফিকুল ইসলামঃ চাকরির বাজার তো সকলেই জানেন। সেই হিসেবে যখন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড ২০২০ সালে কনস্টেবল ও লেডি কনস্টেবল নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়– স্বাভাবিকভাবেই কয়েক লক্ষ তরুণ-তরুণী তাতে আবেদন করে। এখন নিয়োগ পরীক্ষা হবে ২৬ সেপ্টেম্বর।
বর্তমানে চলছে অ্যাডমিট কার্ড সংগ্রহের পালা। সোমবার অন্য বেশ কিছু প্রার্থীর সঙ্গে ১০-১২ জন মুসলিম তরুণীকেও দেখা যায় বিধাননগরের ওয়েস্টবেঙ্গল পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের অফিসে হাজির হতে। তাদের মধ্যে গ্রামবাংলার দূরবর্তী অঞ্চলের তরুণীরাও রয়েছে। তাদের সকলেরই একই বক্তব্য। তারা সঠিকভাবে আবেদনপত্র জমা দিলেও তাদের অ্যাডমিট কার্ড ডাউনলোড করা যাচ্ছে না। সোমবার যে মুসলিম তরুণীরা বিধাননগরের ওয়েস্টবেঙ্গল পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের হেড কোয়ার্টাসে হাজির ছিল– তাদের মধ্যে ছিল সুমাইয়া ইয়াসমিন– হরিহরপাড়া– মুর্শিদাবাদ– সোনামনি খাতুন– দেগঙ্গা– উত্তর ২৪ পরগনা– তুহিনা খাতুন– বেলডাঙা– মুর্শিদাবাদ– ফিরদৌসি খাতুন– মুর্শিদাবাদ– সারিকা পারভিন খাতুন– নদীয়া প্রমুখ।
এই তরুণীরা শান্তভাবে জানার চেষ্টা করে– কেন তাদের অ্যাডমিট কার্ড ডাউনলোড যাচ্ছে না। কারণ তারা প্রত্যেকেই পরীক্ষা ফি বাবদ ধার্য ১৭০ টাকা দিয়েছে। ওবিসিদের পুরো ১৭০ টাকাই দিতে হয়েছে। এসসি ও এসটিরা অবশ্য দিয়েছে মাত্র ২০ টাকা করে। কিন্তু বোর্ডেকে তাদের অভিযোগের জবাব দেবে? রিসেপশন থেকে বলে দেওয়া হয়– যে আধিকারিকরা তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন তাঁরা উপরের তলাগুলিতে বসেন। কিন্তু যে সমস্যা বা অভিযোগ নিয়ে তারা এসেছে তার ভিত্তিতে তাদের উপরের তলায় পাঠানো যাবে না।
অনেক কথাবার্তা– মিনতির পর ওখানে উপস্থিত কয়েকজন কনস্টেবল তাদের জানান– ছবিতে তাদের মুখ খোলা থাকলেও কানের পাশ দিয়ে তাদের মাথা ঢাকা রয়েছে। ‘এদের মধ্যে একজনের মুখ খোলা ছিল– মাথা শুধু শাড়ি দিয়ে ঢাকা ছিল’।
এই তরুণীরা পুবের কলম-কে বলে– আমরা ধর্মীয় কারণে মাথা আবৃত করে রেখেছিলাম। মুখ ছিল পুরো খোলা। সুমাইয়া ইয়াসমিন বলে– হিজাব পরার ধর্মীয় অধিকার সংবিধান আমাকে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড কিভাবে নিয়ম করল যে– মুসলিম মেয়েদের মাথাও পুরোপুরি উন্মুক্ত রাখতে হবে? অন্যদিকে দেগঙ্গার সোনামনির একই বক্তব্য।
এই তরুণীরা পুবের কলমকে বলে– সবথেকে দুঃখ লাগছে কোনও একজনও পুলিশ আধিকারিকও আমাদের বক্তব্য শোনার প্রয়োজন বোধ করলেন না। পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ তো জনগণের বন্ধু। তাদের তো আমাদের বক্তব্য শোনা উচিত। উচ্চস্তরে আমাদের কথা পৌঁছে দেওয়া উচিত। আর যখন মাথা ঢাকা চলবেই না– তখন তারা কেন মাথা ঢাকা অবস্থায় আমাদের ছবি তুললেন এবং ১৭০ টাকা করে জমা নিলেন? এক পর্যায়ে বিধাননগর থানা থেকে পুলিশ এনে সেখানে জমায়েত অ্যাডমিট কার্ড প্রার্থীদের লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করে। বলে এখানে বেশিক্ষণ থাকলে গ্রেফতার করে নিয়ে যাব।
এ সম্পর্কে সেখানে উপস্থিত একজন প্রার্থীর বাবা (যিনি একটি মসজিদের ইমাম) বললেন– ভারত তো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, তাহলে যেটা আমাদের ধর্মচারণের অঙ্গ– তার জন্য আমাদের বঞ্চিত করা ঠিক নয়। আমার মেয়ে বড় আশা করে এসেছিল পুলিশে চাকরি করে সে সমাজের সেবা করবে!
পুবের কলম-এর প্রতিনিধি জানতে পেরেছেন– এখন প্রত্যেকদিনই ৬-৭ জন করে মুসলিম তরুণী তাদের এই সমস্যা নিয়ে বিধাননগর পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে উপস্থিত হচ্ছে। অনেকে বলছেন– যদি বিকল্প কোনও ব্যবস্থা থাকে তাহলে তার মাধ্যমেই মুসলিম তরুণীদের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। প্রয়োজনে দ্বিতীয়বার ছবি তুলে তাদের অ্যাডমিট কার্ডে সংযুক্ত করা হোক।
বিশিষ্ট সমাজসেবী নইম শেখ-এর মত হচ্ছে– ‘সিপিএম আমলে বলা হত মুসলিম তরুণীরা চাকরির জন্য ঘর থেকে বের হয় না। কাজেই চাকরি পাবে কি করে? এখন কিন্তু ঘর থেকে বের হলেও মুসলিম হিসেবে তারা নানা অজুহাতে চাকরি পায় না। তিনি আরও বলেন– শিখরা তো মাথায় পাগড়ি ও লম্বা চুল-দাড়ি নিয়ে আর্মিতেও জেনারেলের চাকরি পাচ্ছেন। যাই হোক হয়তো বা ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম রয়েছে!’ স্থানীয় একজন তৃণমূল নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন– ‘মুসলিম তরুণীদের এই বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর নজরে না আনলে এই সমস্যার সমাধান দ্রুত করা যাবে না।’
দ্বিতীয় আর একটি সমস্যা রয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছেন– টেকনিক্যাল কারণে কয়েক হাজার প্রার্থীর অ্যাডমিট কার্ড ডাউনলোড করা যাচ্ছে না। এর জন্য দায়ি কিন্তু কম্পিউটার বা সফটওয়্যারের ত্রুটি।
২৬ সেপ্টেম্বরের পরীক্ষায় পাশ করলে ৮–৮০০ জন তরুণ-তরুণী কনস্টেবলে চাকরি পাবে।
অতিরিক্ত তথ্যঃ মফিকুল ইসলাম