পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: লাক্ষাদ্বীপ তার সৌন্দর্য্যের জন্য গোটা বিশ্বের কাছে সমাদৃত। বিশেষজ্ঞরা প্রবাল প্রাচীর রক্ষার জন্য পর্যটকদের কাছে আবেদন রেখেছেন। বিত্রা সহ সমগ্র লাক্ষাদ্বীপই ভারতের একমাত্র প্রবালদ্বীপ। এখানকার বাসযোগ্য সম্পূর্ণ ক্ষেত্রটিই বস্তুত উপহ্রদকে বেষ্টনকারী এক প্রবাল প্রাচীর। এর মাটি মূলত প্রবাল থেকে প্রাপ্ত। প্রবাল একজাতীয় প্রাণী যার দ্বারা এই প্রাচীর তৈরি হয়েছে এবং যা সমুদ্রের সকল প্রাণী, বিশেষত মাছকে বাঁচতে সাহায্য করে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভারতের লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জের প্রবাল প্রাচীরগুলি একটি অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। এল নিনোর মতো জলবায়ুর চরম অবস্থা সমুদ্রের উপরিতলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে প্রবালের রং ও জীবনের ক্ষয় ঘটাচ্ছে এবং তাদের দ্বীপটিকে রক্ষা করার ক্ষমতাকে কমিয়ে দিচ্ছে।
লাক্ষাদ্বীপের অন্তর্গত দ্বীপগুলি সব প্রবালদ্বীপ বা কোরাল আইল্যান্ড। কোরাল হচ্ছে এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র জীব যার নাম পলিপ। এই পলিপ বসবাস করে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের এক শক্ত খোলস, এপিথিকার মধ্যে। এই পলিপ ফটো-সিন্থেসিসের মাধ্যমে সমুদ্রের জল থেকে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট সংগ্রহ করে আর খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে খুব ছোটো ছোটো মাছ বা প্ল্যাংকটন। কোটি কোটি পলিপ একত্র হয়ে প্রবাল কলোনি গঠন করে। প্রবালের শক্ত কাঠামো পরস্পর জুড়ে গিয়ে কোরাল রিফ বা প্রবাল প্রাচীর তৈরি করে। পলিপগুলি মৃত হওয়ার পরও এই কাঠামো থেকেই যায় আর তার ওপরে আবার জন্ম নেয় নতুন পলিপ। এই মৃত পলিপের শক্ত কাঠামোকেই আমরা সাধারণত প্রবাল বলি। এই লাক্ষাদ্বীপে অনেক রকমের কোরালের অস্তিত্বের কথা জানা গেছে।
লাক্ষাদ্বীপে আছে মোট ৩৬টি দ্বীপ আর তার মধ্যে ১১টি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। এগুলি হল মিনিকয়, কালপেনি, কাভারাত্তি, অ্যানড্রট, আগাত্তি, আমিনি, কাদমাত, কিস্তান, বিত্রা, চেতলাট আর বাঙ্গারাম। এর মধ্যে বাঙ্গারাম দ্বীপ শুধুমাত্র বিদেশিদের মনোরঞ্জনের জন্য উন্মুক্ত, মাত্র শ’খানেক মানুষের বসতি এখানে। কোচি থেকে এই দ্বীপগুলির দূরত্ব ২৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে।
১৯৯৮, ২০১০, ২০১৬ — এই তিন বছর লাক্ষাদ্বীপ প্রবাল ধোলাইয়ের (কোরাল ব্লিচিং) সাক্ষী হয়েছে। নেচার কনসারভেশন ফাউন্ডেশন নামের মাইসুরু ভিত্তিক বন্যপ্রাণী গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজে ব্রতী একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ২০১৮ সালের অনুসন্ধান বলছে যে প্রবালপ্রাচীর বড়ো বিপদের মধ্যে আছে। ওই অনুসন্ধান আরও বলছে যে লাক্ষাদ্বীপের মোট প্রবাল আচ্ছাদন ১৯৯৮ সালে ৫১.৬ শতাংশ থেকে ২০১৭তে অর্থাৎ মাত্র ২০ বছরের মধ্যে নেমে দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, লাক্ষাদ্বীপ একইসঙ্গে দুটি বড়োমাপের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর বিবর্তনের কারণে প্রবালপ্রাচীরের ক্ষতি হচ্ছে যা মাছের সরবরাহের উপর প্রভাব ফেলছে, আর এর ফলে মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। যদি আমরা সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে প্রবালপ্রাচীরকে ঠিকভাবে রাখতে পারি, তাহলে একে আমরা আরও দীর্ঘসময় বাঁচিয়ে রাখতে পারবো।”
২০২১(এলডিএআর)এর খসড়া লাক্ষাদ্বীপ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি রেগুলেশনের প্রশাসনের প্রকাশনার প্রতিক্রিয়ায় জানায়, ৩৫ টি দ্বীপ (যার মধ্যে ১০টি জনবসতি) নিয়ে গঠিত লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ। গত দুই দশকে (১৯৯৮, ২০১০, ২০১৬ এবং ২০১৯) চারটি প্রধান এল নিনো দক্ষিণ দোলন-সম্পর্কিত তাপমাত্রার বৈষম্য এবং গত চার বছরে তিনটি বিপর্যয়মূলক ঘূর্ণিঝড়ের সাক্ষী হয়েছে। ওখি, মাহা, তাইকতায় ব্যাপক প্রবাল ব্লিচিং নষ্ট হয়। লাক্ষাদ্বীপ রিসার্চ কালেক্টিভ, বাস্তুবিজ্ঞানী এবং সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানীদের একটি দল ২০২১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দকে একটি চিঠি লিখে এই সমস্ত বিষয়টি জানান। ৬০ জন বিজ্ঞানীদের একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতিকে এলডিএআর-২০২১ খসড়া প্রত্যাহার করতে বলেন। খসড়াটি তখন থেকে স্থগিত রাখা হয়েছে, কিন্তু পর্যটনের গন্তব্য হিসেবে লাক্ষাদ্বীপের আগ্রহ তুঙ্গে হলেও সীমাবদ্ধতাগুলি একই রয়ে গেছে। স্প্রিংগার জার্নালে প্রকাশিত একটি ২০১৮ সালের গবেষণাপত্রে দেখা গেছে যে আক্রান্ত প্রাচীর পুনরুদ্ধারের হার ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে গত দুই দশকে নিখুঁত প্রবাল আবরণে ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে যা ১৯৯ সালে ৫১.৬ শতাংশ থেকে ২০১৭ সালে ১১ শতাংশ হয়েছে।
এর মধ্যে গত সপ্তাহে লাক্ষাদ্বীপ সফরে গিয়ে, সেখানকার পর্যটনকে উৎসাহ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরপর, মলদ্বীপের দিক থেকে এসেছে এক আশ্চর্যজনক প্রতিক্রিয়া। ভারত ও প্রধানমন্ত্রী মোদিকে আক্রমণ করে, মলদ্বীপের বেশ কয়েকজন সরকারি কর্তা বলেছেন, মলদ্বীপের থেকে পর্যটকদের নজর ঘোরাতেই নাকি লাক্ষাদ্বীপকে তুলে ধরছেন প্রধানমন্ত্রী। এর ফল হয়েছে ঠিক উল্টো। বহু ভারতীয়ই এখন মলদ্বীপ যাত্রা বাতিল করে, লাক্ষাদ্বীপ যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সোমবার, মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ভারত মিনিকয়ে একটি নতুন সামরিক ও বেসামরিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
উল্লেখ্য, বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস আকস্মিক আগ্নেয় উৎপাতের ফলেই এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রবালের ঘন বেষ্টনী ঘিরে রেখেছে এই দ্বীপগুলিকে। চার্লস ডারউইনের মতে সমুদ্রে সাধারণত মৃত আগ্নেয়গিরিকে ঘিরেই প্রবাল তথা কোরালের সৃষ্টি ও বৃদ্ধি হয়। ক্রান্তীয় জলবায়ু এই পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হয়। আগ্নেয়গিরি সমুদ্রের জলে নিমজ্জিত হলে প্রবাল দিয়ে ঘেরা স্ল্যাটলের সৃষ্টি হয়। এই সব শর্ত মেনেই হয়তো লাক্ষাদ্বীপের প্রবাল দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে এই দ্বীপপুঞ্জের নাম হল লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ, এর আগে এর পরিচিতি ছিল লাক্বাডিভ মিনিকয় ও আমিনদিভি দ্বীপপুঞ্জ।