পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: বর্তমান সময় হানাহানি, রক্তারক্তির যুগে এক অন্য নজির তুলে ধরল পঞ্জাবের মালেরকোটলা জেলা। মানুষে মানুষে ভালোবাসা, সম্প্রীতির দেশ যে ভারত সেটিই প্রমাণ করেছে মালেরকোটলা।
পবিত্র রমযান মাস শুরু হয়েছে। একমাস ব্যাপী এই পবিত্র রোযা পালনের পর খুশির ঈদ পালন করা হয়। রমযানের এই এক মাস কঠোর নিয়মের মধ্যে থাকতে হয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে। ভোরে সূর্য ওঠার আগে সেহরির মাধ্যমে শুরু হয় দিন। সূর্য ডোবার পর ইফতার পালন করা হয়। তবে এই মালেরকোটলা জেলায় ধর্মে ধর্মে কোনও ভেদাভেদ নেই। হিন্দু-শিখ প্রতিবেশীদের বাড়িতে পড়শি মুসলিম ভাইদের সঙ্গে চলেছে এই ইফতার। সন্ধ্যার সময়ে রোযা ভাঙার পরে সকলে মিলে একসঙ্গে ইফতার পর্ব পালন চলছে। হিন্দু-শিখ প্রতিবেশীরাই মুসলিম পরিবারগুলিকে তাদের বাড়িতে একসঙ্গে ইফতার করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। মালেরকোটায় একমাসব্যাপী এই রমযান শুধুমাত্র মুসলিম ধর্মসম্প্রদায় মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। হিন্দু মন্দির ও গুরুদ্বারে ইফতার হয়। মুসলমানরাও হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিশেষ রমযানের দোয়ার মজলিশে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এখানে প্রায় প্রতিদিনই গুরুদোয়ারায় ইফতার ও রমযানের নামাযের আয়োজন রাখা হয়েছে।
সর্বভারতীয় ব্রাহ্মণ ফ্রন্টের সভাপতি মহন্ত স্বরূপ বিহারী শর্মা জানিয়েছেন, তারা কয়েক বছর ধরে এখানে রোযা, ইফতার ও ঈদ পালন করে আসছেন। আমরা হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টানরা মালেরকোটলায় যুগ যুগ ধরে একসঙ্গে আছি। আমি মানুষকে বলতে থাকি ধর্ম নিয়ে কথা বলার আগে আমরা মানুষ হই। কখনও রাজনীতিবিদদের সাম্প্রদায়িক আদর্শকে গুরুত্ব দিই না, তাদের প্রচার করতেও দিইনি। আমাদের উচিত সব উৎসব একসঙ্গে পালন করা। মহন্ত স্বরূপ বিহারী শর্মা আরও বলেন, কোনও ধর্মই ঘৃণা শেখায় না।
প্রসঙ্গত, লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির এবং আকসা মসজিদ মালেরকোটলার হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ সোমসন কলোনিতে একে অপরের পাশে অবস্থিত। স্থানীয়রা জানিয়েছে, মন্দির ও মসজিদের প্রাচীর একটাই। বিগত তিন শতাব্দী ধরে গভীর সম্পর্ককেই তুলে ধরছে এই মালেরকোটলা।
মালেরকোটলার সমৃদ্ধ সংস্কৃতিতে গর্বিত হয়ে, আহমেদগড়ের শ্রী রাম মন্দির কমিটির চেয়ারম্যান, দীপক শর্মা বলেন, ‘আমরা আগামী সপ্তাহে আহমেদগড়ের রাম মন্দিরে রোযা-ইফতারের আয়োজন করছি যার জন্য আমরা আমাদের সমস্ত মুসলিমদের আমন্ত্রণ পাঠিয়েছি। আমাদের কমিটির সদস্যরাও মুসলিম ভাইদের সঙ্গে ঈদ-উল-ফিতর উদযাপনে যোগ দেবেন। আগে আমরা আর্থিকভাবে গরীব মুসলিম পরিবারগুলোকে ইফতারের জন্য শুকনো রেশন দিয়ে থাকতাম। কিন্তু বর্তমানে আমরা বিশেষ ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি।’
বিশিষ্ট সম্প্রদায়ের নেতা নাসির খান যিনি একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গোষ্ঠী পরিচালনা করেন। নাসির জানিয়েছেন, মালেরকোটলায় শিখ-মুসলিম সানজান ফাউন্ডেশন, ইফতারের আমন্ত্রণগুলি কেবল শহুরে এলাকায় সীমাবদ্ধ নয়। নাসির গর্বিতভাবে বলেন, যে হিন্দু এবং শিখরাও তাদের সঙ্গে একসঙ্গে নামায পড়েছেন, এমন একটি দৃশ্য দেশের কোথাও খুঁজে পাওয়া কঠিন। মালেরকোটলা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির স্থাপন করেছে এবং আমরা নিজেকে ধন্য মনে করছি। তবে নাসির দুঃখ প্রকাশ বলেন, এই ধরনের খবর সংবাদমাধ্যম জানায় না।
শিরোমণি আকালি দলের সার্কেল সভাপতি, শিখ ব্যবসায়ী অমর সিং সারাও মালেরকোটলার আহমেদগড়ে গুরু নানক মিশন সেবা সোসাইটি পরিচালনা করেন। অমর সিং বলেছেন যে, ধর্মের নামে মানুষকে বোকা বানানো হচ্ছে, সে কারণেই তিনি রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখি। অমর সিং জানিয়েছেন, প্রতি বছরের মতো আমরা এই বছরেও ইফতারের আয়োজন করেছি।
উল্লেখ্য, মালেরকোটলার মুসলমানরা ২০২০ সালে শাম্বু সীমান্তে চলা কৃষকদের বিক্ষোভে যোগ দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ২০২৩ সালের বিধ্বংসী পঞ্জাব বন্যার সহ করোনার সময় তারা এগিয়ে আসে, অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরের লঙ্গারের জন্য ৩৩০ কুইন্টাল গম দান করেছেন।
প্রসঙ্গত, মালেরকোটলা একটি ঐতিহাসিক রাজ্য, ১৪৫৪ সালে বর্তমান আফগানিস্তানের একজন শাসক শেখ সদরউদ্দিন-ই-জাহান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
২০২১ সালে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং মালেরকোটলাকে পঞ্জাবের ২৩ তম জেলায় উন্নীত করেছিলেন। মালেরকোটলা ঐতিহাসিকভাবে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরল দৃশ্য হিসেবে স্বীকৃত। দেশভাগের অন্ধকার সময়ে, যখন নাভা, জিন্দ এবং পাতিয়ালা রাজ্যগুলি সহ সমগ্র পূর্ব পঞ্জাব সাম্প্রদায়িক সহিংসতার উন্মত্ততায় আচ্ছন্ন ছিল, তখন মালেরকোটলা শান্ত ছিল।