সালাম লহ, হে মহাত্মা মহসিন

- আপডেট : ১ অগাস্ট ২০২৫, শুক্রবার
- / 436
পুবের কলম ওয়েবডেস্ক : সালাম লহ, হে মহাত্মা মহসিন।/ ইতিহাসে নয়, মানব হৃদয়ে তব নাম চিরদিন/ প্রেমাশ্রুজলে লেখা র’বে প্রিয় আত্মীয় স্মৃতি-সম,/ মানবাত্মার নিত্য বন্ধু, মহাত্মা নিরুপম!——কাজী নজরুল ইসলাম
এই পৃথিবীতে মানুষকে লড়াই করতে হয় বিরাট প্রতিকূলতার সঙ্গে। বেশি সুখ, আরও বেশি স্বাচ্ছন্দই হয়ে ওঠে তার কামনা। তাতে মানুষ হয়ে ওঠে স্বার্থপর ও অমানবিক। তখন সে তার সহনাগরিক, এমনকি পাশের লোকটির কথাও ভাবে না। এভাবেই পৃথিবীতে দেখা গেছে অসাম্য ও ভেদভাব। কিন্তু আবার এর উল্টো স্রোতও দেখা গেছে এই পৃথিবীতে আবহমানতার ধারায়। কিছু মানুষ বেঁচেছেন শুধু অন্যের সুখ ও শান্তির কামনায়।
বিপুল ধন-সম্পদ-জ্ঞানের অধিকারী হয়েও অতিসাধারণ ভাবে জীবনযাপন করেছেন। এরকমই একজন অন্যান্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন এই বাংলার সু-সন্তান হাজি মুহাম্মদ মহসিন। মানবকল্যাণে তাঁর উজাড় করা দান আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, তাঁর মৃত্যুর দু-শো বছর পরও। তাঁর ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবতা আমাদের কাছে উজ্জ্বল উদাহরণ।
হাজি মুহাম্মদ মহসিন ১৭৩২ সালে ১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন হুগলি শহরে। এই শহরের অল্প দূরেই অবস্থিত রাধানগর গ্রামে ১৭৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন ভারতে নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়। মহসিনের দাদু আগা ফজলুল্লাহ ও পিতা হাজি ফইজুল্লাহ প্রথমে মুর্শিদাবাদ ও পরে হুগলিতে স্থায়ীভাবে বসবাস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন।
মহসিনের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁর ১৪ বছরের বড় দিদি মরিয়ম খানম বা মন্নুজান খানম। মন্নুজান বিবাহ করেন বাংলা, বিহার, ওড়িশার নবাব আলিবর্দী খাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী মির্জা সালাহউদ্দিনের সঙ্গে। তাঁদের কোনও সন্তান ছিল না, তাই মন্নুজান ছোট ভাই মহসিনকে পুত্র স্নেহে লালন পালন করেছিলেন। এবং মৃত্যুর আগে মহসিনকে তাঁর বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে যান।
এই স্নেহময়ী ও মমতাময়ী মন্নুজান সম্পর্কে আরো দু-একটি কথা বলা অত্যন্ত জরুরি। মহসিন ছিলেন মন্নুজানের সৎভাই। মন্নুজানের পিতা ছিলেন আগা মোতাহার। তিনি দিল্লির মুঘল দরবারে কাজ করতেন। তাঁর কর্মদক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তায় খুশি হয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে যশোর ও নদিয়া জেলার খাজনা আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে বাংলায় পাঠান। সম্রাট তাঁকে এসব অঞ্চলের জায়গিরও দান করেন। সম্রাট প্রদত্ত এসব কাজ ছাড়াও বিচক্ষণ মোতাহার ব্যবসা বাণিজ্যও শুরু করেন এবং প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হন।
সংসারে অত্যন্ত সফল এই মানুষটির হঠাৎ জীবনাবসান হয়। মন্নুজানের তখন বয়স সাত বছর। অবশ্য উল্লেখ্য আগা মোতাহার মৃত্যুর আগে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি কন্যা মন্নুজানকে দিয়ে যান। এই সময় তাঁদের পরিবারের দেখভালের জন্য আসেন আগা মোতাহারের নিকট আত্মীয় আগা ফয়জুল্লাহ। অল্পদিনের মধ্যেই এই ফয়জুল্লাহকেই বিয়ে করেন মন্নুজানের মা জয়নার বেগম। আর আগা ফয়জুল্লাহ ও জয়নাবেরই সন্তান হল হাজি মুহাম্মদ মহসিন।
সৎভাই হলেও মন্নুজান মহসিনকে খুব আদর স্নেহ করতেন। এবং পরবর্তীকালে তাঁর পিতা ও স্বামীর সূত্রে পাওয়া তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ছোট ভাই মহসিনকে উত্তরাধিকারী করেন। মমতাময়ী মন্নুজানের এই সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্তকারী, কারণ তিনি এই সম্পত্তি মহসিনকে না দিলে মুহাম্মদ মহসিন এডুকেশন এনডাওমেন্ট ফান্ড এবং তার অর্থে প্রতিষ্ঠিত হুগলি মহসিন কলেজসহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপ স্কিম—এসব কিছুরই অস্তিত্ব থাকত না।
মহীয়সী মন্নুজানের নিজের জীবনের আরও কিছু খবর পাঠকের জেনে রাখা দরকার। মহসিনের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে বহু ঘটনা ঘটে গেছে তাঁর জীবনে। রূপবতী, তার উপর বিপুল সম্পত্তির অধিকারিণী। অনেকেই তাঁকে বিয়ে করতে চান, তিনি রাজি না হওয়ায় তাঁর প্রাণনাশেরও চেষ্টা করা হয়। অবেশেষ মন্নুজান বিবাহ করেন মির্জা সালাহউদ্দিনকে। জানা যায় বাংলায় বর্গী আক্রমণ প্রতিহত করতে সালাহউদ্দিন নবাব আলিবর্দিকে যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন। তাঁর বুদ্ধি ও দূরদর্শিতায় নবাবও খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
এর ফলশ্রুতি অবশ্যই পদোন্নতি ও ধন-সম্পদ লাভ। বিলাস বৈভবের মধ্য দিয়ে মন্নুজান ও সালাহউদ্দিনের জীবন বেশ কাটছিল। সুখী দাম্পত্য, তবু একটা হতাশা তাদের সবসময় ঘিরে রাখত। তাঁদের কোনও সন্তান ছিল না। এই হতাশা কাটানোর জন্য একটা মহৎ পন্থা তাঁরা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি দানধ্যান ও ও সমাজ মঙ্গলের কাজে বেশি বেশি করে সময় ও সম্পদ ব্যয় করতেন। এইসব কারণে তাদের প্রভূত সুনাম ছিল। এভাবেও জীবনতরী বেশিদিন বইল না। খুব অল্পবয়সে সালাহউদ্দিনের দেহাবসান হয়। নিঃসন্তান মন্নুজান বিধবা হলেন।
স্নেহের ভাই বিদেশ-বিভুঁই-এ, স্বামী ও পিতার রেখে যাওয়া বিপুল সম্পত্তির দেখভালের দায়িত্ব এখন তাঁর উপর। তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলেন প্রাণপ্রিয় ভাই মহসিনের ঘরে ফেরার জন্য। দিদি ও নিজের সম্পত্তি মিলিয়ে হাজি মহম্মদ মহসিন হয়ে উঠলেন বাংলার অন্যতম ধনী মানুষ। তবে তিনি এই সম্পত্তি স্রষ্টার উপহার হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। এবং স্থির করেছিলেন মানুষের স্বার্থেই তিনি এই সম্পত্তি ব্যবহার করবেন।
নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ সকলের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা ও দারিদ্রের দুর্দশা দূর করা ইত্যাদি মঙ্গল কাজে উৎসর্গ করেছিলেন। এই সম্পদ তাঁর জীবনকালে এবং মৃত্যুর পরে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের শিক্ষালাভের সুযোগ করে দিয়েছে—হুগলি, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহিতে গড়ে উঠেছে স্কুল , মাদ্রাসা কলেজ। এইসব উচ্চমানের কলেজে এখন স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা হয়। হুগলি মহসিন কলেজে একসময় পড়াশোনা করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, ইউ এন ব্রহ্মচারী, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, সৈয়দ আমির
আলি, মির্জা দেলওয়ার হোসেন, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের মতো কৃতি বাঙালি।
ছোটবেলা থেকেই মহসিনের ছিল বিদেশ ভ্রমণের আগ্রহ আর তীব্র জ্ঞানপিপাসা। তাই দিদির বিয়ের পর তিনি বেরিয়ে পড়লেন— প্রথমে পবিত্র মক্কা, সেখানে হজব্রত পালন করলেন। তারপর একে একে আরব, পারস্য, মিশর ও তুরস্ক ভ্রমণ সেরে দীর্ঘ ২৭ বছর পর স্বদেশ ফিরলেন।
এই দীর্ঘ ভ্রমণের সময় মহসিন আরব দেশের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে বিভিন্ন দর্শন সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন এবং রপ্ত করেছিলেন অনেকগুলো ভাষা— ইংরেজি, আরবি, ফারসি ও উর্দু। তাঁর জ্ঞান ও জীবনদর্শনের কথা এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে লখনউ-এর নবাব আসিফুদ্দৌলা তাঁর দরবারে পরামর্শদাতা হিসাবে থাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মহসিন সে প্রস্তাব গ্রহণ করেননি, কারণ তিনি মানুষের মাঝে মানুষের সঙ্গে থাকতে চেয়েছেন।
তিনি দেখেছিলেন জগতে বিপুল বৈষম্য ও মানুষের দুঃখকষ্ট। তাই তিনি প্রাসাদের সুখ ভোগ দূরে সরিয়ে রেখে নেমেছিলেন পথে, মানুষের পাশে দাঁড়াবেন বলে। প্রতিদিন রাতে তিনি গরিব এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে বেড়াতেন এবং ক্ষুধার্তদের খাবার, বস্ত্রহীনদের কাপড় ও রোগীদের ওষুধ দান করতেন। আর এই দানধ্যানের কাজে কোনও ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনি বিভেদ করতেন না—সকলকে সমান চোখে দেখতেন।
মক্তব ও টোল শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে বেরিয়ে এসে আধুনিক শিক্ষাবিস্তারে মহসিন অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি হুগলিতে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। বিদ্যালয়টি ছিল অবৈতনিক এবং মুসলমান, হিন্দু সব ধরনের পড়ুয়ারা সেখানে পড়াশোনা করতে পারত। তাই বলা যায় হাজি মুহাম্মদ মহসিন তাঁর সময়ে অর্থাৎ রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনেক আগে শিক্ষার আলো ছড়াতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
এছাড়া হাজি মুহাম্মদ মহসিন হুগলিতে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় চালু করেছিলেন। বহু মানুষ প্রতিদিন ইমামবাড়া সংলগ্ন ওই দাতব্য চিকিৎসালয়ে আসতেন চিকিৎসার জন্য। আর হুগলিতে আগত অতিথি অর্থাৎ মুসাফিরদের জন্য তিনি খুলেছিলেন মুসাফিরখানা, সেখানে বিনা খরচে থাকা খাওয়ার সু-বন্দোবস্ত ছিল।
তিনি নিজের হাতে কুরআনের অনুলিখন করতেন। তার কারণ সম্ভবত সেই সময় হুগলিতে তথা বাংলায় আরবি হরফে কুরআন ছাপার ব্যবস্থা ছিল না। মহসিন তাঁর সুন্দর হাতের লেখায় মোট ৭২টি কুরআন লিখেছিলেন বলে জানা যায়। তৎকালীন ধনী ব্যক্তিরা মহসিনের হাতে লেখা কুরআন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নিয়ে যেতেন। আর সেই অর্থ মহসিন দরিদ্র সেবায় ব্যয় করতেন। এভাবেই মানুষের প্রতি নিজের ভালোবাসা আর সম্পদ বিলিয়ে দিতেন।
অকৃতদার হাজি মুহাম্মদ মহিসনের কোনও বংশধর ছিল না, তাই তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর এই বিপুল সম্পত্তির কী হবে সে বিষয়ে ভাবতে শুরু করেন। অবশেষে ১৮০৬ সালে তাঁর স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির তিনি একটি ট্রাস্ট দলিল করলেন এবং জনহিতে অর্পণ করলেন। এবং এই ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী স্থির হয় তাঁর সম্পদের সমস্ত আয় চিরকালের জন্য ধর্মীয় ও জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হবে।
এই ভাবনারই ফলশ্রুতি হুগলি মাদ্রাসা, হুগলি মহসিন কলেজ, হুগলি ইমামবাড়া ও হুগলি ইমামবাড়া সদর হাসপাতাল। দানবীর মহসিনের রেখে যাওয়া সম্পত্তি ব্যবহার করে সমাজ উন্নয়নের কাজ শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, তৎকালীন পূর্ববঙ্গে, অধুনা বাংলাদেশেও প্রসারিত হয়েছিল।