০১ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জম্মু ফাইলস্­ ১৯৪৭ সালের ভয়াবহ মুসলিম গণহত্যা নিয়ে সবাই চুপ কেন?

ইমামা খাতুন
  • আপডেট : ৪ এপ্রিল ২০২২, সোমবার
  • / 14

FILE IMAGE

বিশেষ প্রতিবেদন : জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কোনও নির্দোষ মানুষের হত্যা ক্ষমার অযোগ্য এবং অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু কোনও ধর্মবিশেষের অনুসারীদের হত্যার ঘটনাকে যখন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয় অন্য এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তখন তাকে কী বলা হবে?
‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস্’ ছবিতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যা এবং উপত্যকা থেকে পলায়নের ঘটনা দেখানো হয়েছে। অথচ প্রায় একই পরিস্থিতিতে ও সময়ে কাশ্মীরে হত্যা করা হয়েছে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে। বরং হিন্দুদের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যায় মারা গেছেন কাশ্মীরি মুসলিমরা। ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ ছবিটির নির্মাতা-নির্দেশক মুসলিম হত্যার কথা বাদ দিয়ে যখন শুধু হিন্দু পণ্ডিতদের হত্যার কথা তুলে ধরেন, তখন তার অভিসন্ধি প্রকাশ পায়।

 

১৯৯০ সালে কাশ্মীরে জঙ্গি দৌরাত্ম্য যখন চরমে পৌঁছেছিল, সেই সময় সন্ত্রাসীদের হাতে মারা গিয়েছিলেন পণ্ডিতরা এবং তার পরবর্তী সময়ে কাশ্মীর ছেড়ে ভয়ে পালিয়ে যান তারা। তাদের কাশ্মীর ত্যাগে সক্রিয় উৎসাহ ও প্রেরণা যুগিয়েছিলেন তৎকালীন গভর্নর জগমোহন। তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ছিলেন। জগমোহন কাশ্মীরের পণ্ডিতদের জম্মু ও দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে সাম্প্রদায়িক ইস্যু তৈরি করতে চাইছিলেন। কিন্তু তার বহু আগে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার দু’মাস পরে জম্মুতে হত্যা করা হয়েছিল দু’লক্ষ মুসলমানকে। এই ইতিহাস নিয়ে কেউ আলোচনা করেন না, বিশেষ স্বার্থের খাতিরে স্বাধীন ভারতে সেই ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।

 

এটা ঠিক, কোনও মানুষের হত্যা অপর একজনের হত্যার কারণ হতে পারে না। কিন্তু পণ্ডিতদের ইতিহাস যখন সামনে আনা হয়েছে, তখন ১৯৪৭ সালে জম্মুতে মুসলিমদের সঙ্গে কী মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সেই ইতিহাসও সামনে আনা দরকার। ১৯৯০ সালে যদি কাশ্মীরে পণ্ডিতদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়ে থাকে, তাহলে জম্মুতে মুসলিমদের গণহত্যা করা হয়েছিল। মহারাজা হরি সিং-এর নেতৃত্বে ডোগরা রাজ্যে মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতি শুরু হয়েছিল।

হোরেস আলেকজান্ডার লন্ডনের ‘দ্য স্পেক্টেটর’ পত্রিকায় ১৯৪৮ সালের ১৬ জানুয়ারি তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন, জম্মুতে দু’লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল এবং এক বিরাট সংখ্যক মুসলমানকে জম্মু থেকে বিতাড়িত করা হয়। তারা পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে পালিয়ে গিয়েছিল। আমস্টার্ডামের ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল হিস্ট্রির অধ্যাপক ইদ্রিশ কানথ জানিয়েছেন, দেশভাগের মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল জম্মুর উপর। জম্মুর মুসলিম প্রজাদের, মহারাজার ডোগরা সেনারা পরিকল্পনামাফিক জম্মু ছাড়তে বাধ্য করেছিল। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে তিন সপ্তাহ ধরে মুসলিম নিধন ঘটেছিল ডোগরা সেনার হাতে। মুসলিমদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার নাম করে তাদের জম্মুর রাজৌরির জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হয়। তখন জম্মুতে মুসলিমদের জনসংখ্যা ছিল ৬০ শতাংশ। এর পর মুসলিমরা সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়।

 

১৯৪৮ সালের ১০ আগস্ট লন্ডনের দ্য টাইমস্ পত্রিকা তাদের রিপোর্টে জানায়, মহারাজার নির্দেশে ডোগরা সেনা হিন্দুদের সাহায্যে ২,৩৭, ০০০ মুসলিমকে হত্যা করে। এদের মধ্যে কিছু পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পি জি রসূল তাঁর ‘দ্য হিস্টরিকাল রিয়েলিটি অব কাশ্মীর ডিসপিউট’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, রাজ্যের তত্ত্বাবধানে এবং প্রত্যক্ষ মদদে দু’লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল জম্মুতে। তার পরে সেখানে আরএসএস ডেকে গোটা পরিস্থিতির সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়। জম্মুতে গিয়ে যখন সেখানকার মুসলিম প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা করে ঘটনার বীভৎসতার কথা জানতে পারেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং কাশ্মীরের নেতা শেখ আবদুল্লাহ, তখন পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার ভয়ে তাঁরা বিষয়টি চেপে যান।

 

রসূল তাঁর বইয়ে বলেছেন, কাশ্মীরে প্রথম থেকেই মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। রাজনৈতিক নেতারা চাননি জম্মুতে মুসলিমদের গণহত্যার কথা উপত্যকার মানুষ জানুক। যারা আজ ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস্’ নিয়ে সমাজে ধর্মের নামে বিভাজনের রাজনৈতিক খেলায় মেতেছেন শুধু ভোটের জন্য, তারা জম্মু ফাইলস্ নিয়ে চুপ কেন?

 

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

জম্মু ফাইলস্­ ১৯৪৭ সালের ভয়াবহ মুসলিম গণহত্যা নিয়ে সবাই চুপ কেন?

আপডেট : ৪ এপ্রিল ২০২২, সোমবার

বিশেষ প্রতিবেদন : জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কোনও নির্দোষ মানুষের হত্যা ক্ষমার অযোগ্য এবং অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু কোনও ধর্মবিশেষের অনুসারীদের হত্যার ঘটনাকে যখন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয় অন্য এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তখন তাকে কী বলা হবে?
‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস্’ ছবিতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যা এবং উপত্যকা থেকে পলায়নের ঘটনা দেখানো হয়েছে। অথচ প্রায় একই পরিস্থিতিতে ও সময়ে কাশ্মীরে হত্যা করা হয়েছে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে। বরং হিন্দুদের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যায় মারা গেছেন কাশ্মীরি মুসলিমরা। ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ ছবিটির নির্মাতা-নির্দেশক মুসলিম হত্যার কথা বাদ দিয়ে যখন শুধু হিন্দু পণ্ডিতদের হত্যার কথা তুলে ধরেন, তখন তার অভিসন্ধি প্রকাশ পায়।

 

১৯৯০ সালে কাশ্মীরে জঙ্গি দৌরাত্ম্য যখন চরমে পৌঁছেছিল, সেই সময় সন্ত্রাসীদের হাতে মারা গিয়েছিলেন পণ্ডিতরা এবং তার পরবর্তী সময়ে কাশ্মীর ছেড়ে ভয়ে পালিয়ে যান তারা। তাদের কাশ্মীর ত্যাগে সক্রিয় উৎসাহ ও প্রেরণা যুগিয়েছিলেন তৎকালীন গভর্নর জগমোহন। তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ছিলেন। জগমোহন কাশ্মীরের পণ্ডিতদের জম্মু ও দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে সাম্প্রদায়িক ইস্যু তৈরি করতে চাইছিলেন। কিন্তু তার বহু আগে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার দু’মাস পরে জম্মুতে হত্যা করা হয়েছিল দু’লক্ষ মুসলমানকে। এই ইতিহাস নিয়ে কেউ আলোচনা করেন না, বিশেষ স্বার্থের খাতিরে স্বাধীন ভারতে সেই ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।

 

এটা ঠিক, কোনও মানুষের হত্যা অপর একজনের হত্যার কারণ হতে পারে না। কিন্তু পণ্ডিতদের ইতিহাস যখন সামনে আনা হয়েছে, তখন ১৯৪৭ সালে জম্মুতে মুসলিমদের সঙ্গে কী মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সেই ইতিহাসও সামনে আনা দরকার। ১৯৯০ সালে যদি কাশ্মীরে পণ্ডিতদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়ে থাকে, তাহলে জম্মুতে মুসলিমদের গণহত্যা করা হয়েছিল। মহারাজা হরি সিং-এর নেতৃত্বে ডোগরা রাজ্যে মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতি শুরু হয়েছিল।

হোরেস আলেকজান্ডার লন্ডনের ‘দ্য স্পেক্টেটর’ পত্রিকায় ১৯৪৮ সালের ১৬ জানুয়ারি তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন, জম্মুতে দু’লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল এবং এক বিরাট সংখ্যক মুসলমানকে জম্মু থেকে বিতাড়িত করা হয়। তারা পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে পালিয়ে গিয়েছিল। আমস্টার্ডামের ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল হিস্ট্রির অধ্যাপক ইদ্রিশ কানথ জানিয়েছেন, দেশভাগের মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল জম্মুর উপর। জম্মুর মুসলিম প্রজাদের, মহারাজার ডোগরা সেনারা পরিকল্পনামাফিক জম্মু ছাড়তে বাধ্য করেছিল। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে তিন সপ্তাহ ধরে মুসলিম নিধন ঘটেছিল ডোগরা সেনার হাতে। মুসলিমদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার নাম করে তাদের জম্মুর রাজৌরির জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হয়। তখন জম্মুতে মুসলিমদের জনসংখ্যা ছিল ৬০ শতাংশ। এর পর মুসলিমরা সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়।

 

১৯৪৮ সালের ১০ আগস্ট লন্ডনের দ্য টাইমস্ পত্রিকা তাদের রিপোর্টে জানায়, মহারাজার নির্দেশে ডোগরা সেনা হিন্দুদের সাহায্যে ২,৩৭, ০০০ মুসলিমকে হত্যা করে। এদের মধ্যে কিছু পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পি জি রসূল তাঁর ‘দ্য হিস্টরিকাল রিয়েলিটি অব কাশ্মীর ডিসপিউট’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, রাজ্যের তত্ত্বাবধানে এবং প্রত্যক্ষ মদদে দু’লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল জম্মুতে। তার পরে সেখানে আরএসএস ডেকে গোটা পরিস্থিতির সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়। জম্মুতে গিয়ে যখন সেখানকার মুসলিম প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা করে ঘটনার বীভৎসতার কথা জানতে পারেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং কাশ্মীরের নেতা শেখ আবদুল্লাহ, তখন পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার ভয়ে তাঁরা বিষয়টি চেপে যান।

 

রসূল তাঁর বইয়ে বলেছেন, কাশ্মীরে প্রথম থেকেই মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। রাজনৈতিক নেতারা চাননি জম্মুতে মুসলিমদের গণহত্যার কথা উপত্যকার মানুষ জানুক। যারা আজ ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস্’ নিয়ে সমাজে ধর্মের নামে বিভাজনের রাজনৈতিক খেলায় মেতেছেন শুধু ভোটের জন্য, তারা জম্মু ফাইলস্ নিয়ে চুপ কেন?