০৫ মে ২০২৫, সোমবার, ২২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর, হাজার হাজার কাশ্মীরি বিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হয়, বেশিরভাগকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কাশ্মীরে ‘রাজনৈতিক বন্দি’ -দের মুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা, পহেলগাঁও হামলার পর উদ্বেগ বেড়েছে

আফিয়া‌‌ নৌশিন
  • আপডেট : ৫ মে ২০২৫, সোমবার
  • / 28

শাকিলা ও তার ভাইয়ের সাথে শ্রীনগরের বাড়িতে বসে আছেন।

পুবের কলম ডেস্ক:  গত বছরের অক্টোবর মাসে জম্মু ও কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচনের ভোট গণনা চলার সময় এক ৫০ বছর বয়সী  মা, শাকিলা, আশায় ছিলেন যে তাঁর একমাত্র ছেলে, ২৪ বছর বয়সী ফাইযা‌ব, ভারতের জেল থেকে ছাড়া পাবে। তিন বছর ধরে তিনি এই আশায় ছিলেন।

২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে এবং অঞ্চলটিকে সরাসরি দিল্লির নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এরপর থেকে হাজার হাজার কাশ্মীরিকে গ্রেফতার করা হয়, যারা জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। এদের মধ্যে অনেককে “সন্ত্রাসবাদে জড়িত” বা “ভারতবিরোধী” কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছে। বেশিরভাগকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আরও পড়ুন: নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী প্রধানদের পর, প্রতিরক্ষা সচিবের সঙ্গে মোদির বৈঠক

অনেক কাশ্মীরি পরিবার আশা করেছিল, নির্বাচনের মাধ্যমে একটি আঞ্চলিক সরকার গঠিত হলে বন্দিদের মুক্তির পথ খুলবে। কিন্তু গত মাসে পহেলগাঁও  হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর সেই আশা ধাক্কা খেয়েছে।এই হামলাটি গত ২৫ বছরে কাশ্মীরে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে ধরা হচ্ছে। এরপর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে।

আরও পড়ুন: ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে আজ রুদ্ধদ্বার আলোচনা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে

শাকিলা জানান, পহেলগাঁও হামলার খবর শোনার পর থেকে তিনি ভয় ও উদ্বেগে ভুগছেন। তাঁর আশঙ্কা, নতুন করে আরও ধরপাকড় শুরু হবে এবং তাঁর ছেলের মুক্তির সম্ভাবনা আরও কমে যাবে। কারণ, তাঁর ছেলে ইতিমধ্যে পহেলগাঁও হমলার সন্ত্রসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ধারায় অভিযুক্ত। তিনি বলেন, “নির্বাচনের পর আমার ছেলের মুক্তির সামান্য আশা ছিল। কিন্তু এখন সেটা মুছে গেছে। আমি মনে করি, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।”

আরও পড়ুন: তাঁর থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া উচিত দেশবাসীর নৌসেনার স্ত্রীর প্রশংসায় মেহবুবা

২০২৪ সালের বিধানসভা  নির্বাচনটি অনেক কাশ্মীরির কাছে গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার একটি সুযোগ ছিল। ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬৪ শতাংশ, যা লোকসভা নির্বাচনের থেকেও বেশি।

অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তারা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেবে বা অন্তত কাশ্মীরের জেলগুলোতে স্থানান্তর করবে। জাতীয় কনফারেন্স (এনসি) ৯০টির মধ্যে ৪২টি আসনে জিতে সরকার গঠন করে। তবে এখনও পর্যন্ত বন্দিদের মুক্তি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

শাকিলা জানান, তিনি এনসিকে ভোট দিয়েছিলেন। কারণ তারা বলেছিল বন্দিদের মুক্তির জন্য কাজ করবে। কিন্তু এখন ছয় মাস হয়ে গেলেও কিছুই করা হয়নি। “তারা আমাদের আবেগ নিয়ে খেলেছে ভোট পাওয়ার জন্য,” । ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর রাতে পুলিশের একটি দল তাঁদের বাড়িতে আসে এবং ফাইযা‌বকে গ্রেফতার করে। পুলিশ বলে, সে এক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। তাঁকে ইউএপিএ (UAPA) আইনে গ্রেফতার করা হয়, যা বিচার ছাড়াই দীর্ঘদিন আটকে রাখার সুযোগ দেয়।

প্রথমে তাকে শ্রীনগরের একটি জেলে রাখা হয়, পরে ৩০০ কিলোমিটার দূরের জম্মুতে স্থানান্তর করা হয়। শাকিলা জানান, অর্থের অভাবে তিনি আট মাস ধরে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। “আমার কোনো উপার্জনের উৎস নেই। আমার ছেলে ছিল একমাত্র ভরসা। সেই ভরসাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে,” তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, “আরও একটি ঈদ এলো আর চলে গেল, কিন্তু আমার ছেলে পাশে ছিল না। ঈদের দিন আনন্দের সময়, কিন্তু আমার জন্য সেটি কষ্টের দিন হয়ে দাঁড়ায়। আমার ঈদ হবে যেদিন আমার ছেলে মুক্ত হবে।” শাকিলার মতো অনেক পরিবার আছেন, যাঁদের প্রিয়জন কাশ্মীরের বাইরে জেলে বন্দি। অধিকাংশই আর্থিক সমস্যার কারণে তাঁদের দেখতে যেতে পারেন না।

পুলওয়ামা জেলার ২৯ বছর বয়সী ইশরাত তাঁর ২৫ বছর বয়সী ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। ২০২৩ সালের জুনে তাঁকে পিএসএ (PSA) আইনে গ্রেফতার করা হয়। এ আইনে ওয়ারেন্ট ছাড়াই কাউকে দুই বছর পর্যন্ত আটক রাখা যায়।

২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১০০-এর বেশি মানুষকে PSA-তে আটক করে কাশ্মীরের বাইরে পাঠানো হয়েছে। ২০১৯ সালের পর থেকে এই ধারা দেওয়ার পরিমান আরও বেড়েছে। ইশরাতের ভাইকে প্রথমে জম্মুতে রাখা হয়, পরে উত্তর প্রদেশের এক জেলে পাঠানো হয় – যা তাঁদের বাড়ি থেকে ১,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। তিনি বলেন, ভ্রমণের খরচের কারণে তাঁরা ভাইকে দেখতে যেতে পারেন না। ইশরাত বলেন, রমজান মাসে তাঁর ভাই ও অন্য বন্দিরা দুপুরের খাবারই ইফতার ও সেহরির জন্য রেখে দিতেন। সেলে একটি মাত্র ফ্যান রয়েছে, যা ২৫ ফুট ওপরে স্থাপিত – গরমে এটি কোনও কাজেই আসে না। “প্রতিদিনই যেন জেলের ভেতরে নরকের আগুনে দিন কাটাচ্ছে,”।

[ আরও পড়ুন: ইসরাইলি অবরোধে মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে গাজার ২,৯০,০০০ শিশু ]

তাঁদের মা, যাঁর বয়স প্রায় ৫০, ছেলের বিচ্ছেদে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। সপ্তাহে দুইবার ফোনে মাত্র ৫ মিনিটের কথোপকথনই তাঁদের একমাত্র সান্ত্বনা। ইশরাত বলেন, নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের গ্রামে এসে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বন্দিদের মুক্তি বা অন্তত কাশ্মীরে ফিরিয়ে আনার। “আমাদের পরিবার সবাই ভোট দিয়েছিল। ভেবেছিলাম নতুন সরকার কিছু করবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। মনে হচ্ছে সরকার আমাদের ভুলে গেছে,” তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, “আমার ভাই যদি অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাঁকে কাশ্মীরে বিচার করে সাজা দিন। কিন্তু হাজার কিলোমিটার দূরে পাঠানো পরিবারগুলোর জন্য অন্যায়।”

জাতীয় কনফারেন্সের মুখপাত্র ইমরান নবি দার বলেন, কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা বাতিল এবং একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে থাকা নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার কারণে সরকার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারছে না। সরকার গঠনের কিছু মাস হয়েছে মাত্র। আমাদের সামনে পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ রয়েছে, যারা গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত নন এবং যারা অন্যায়ভাবে আটক, তাদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি তাঁরা রেখেছেন।আমরা জানি পরিবারের যন্ত্রণা কতটা। আমরা তাঁদের ভুলিনি। আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এই সমস্যা সমাধান হবে। পহেলগাঁও হামলার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কাশ্মীরে নিরাপত্তা জোরদার হয়েছে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের আশঙ্কা বেড়েছে।

[ আরও পড়ুন: আমি এখন কীভাবে তোমায় জড়িয়ে ধরব মা? – ফিলিস্তিনি মাহমুদ ]

পহেলগাঁও হামলার পর হাজারের বেশি মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ৯০ জনকে পিএসএ আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেক বিদ্রোহী সন্দেহভাজনের বাড়িও ভেঙে ফেলা হয়েছে।

কাশ্মীরি অধ্যাপক ও বিশ্লেষক শেখ শওকত হুসেইন বলেন, “কাশ্মীরে বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক কারণে লোকজনের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এখন তাঁদের কাশ্মীরের বাইরে পাঠানো হচ্ছে, যা পরিবারগুলোর জন্য আরও কষ্টের।”

তিনি বলেন, এটি ভারতের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এতে কাশ্মীরিদের মধ্যে আরও বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে।

সূত্র: আল জাজিরা

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর, হাজার হাজার কাশ্মীরি বিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হয়, বেশিরভাগকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কাশ্মীরে ‘রাজনৈতিক বন্দি’ -দের মুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা, পহেলগাঁও হামলার পর উদ্বেগ বেড়েছে

আপডেট : ৫ মে ২০২৫, সোমবার

পুবের কলম ডেস্ক:  গত বছরের অক্টোবর মাসে জম্মু ও কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচনের ভোট গণনা চলার সময় এক ৫০ বছর বয়সী  মা, শাকিলা, আশায় ছিলেন যে তাঁর একমাত্র ছেলে, ২৪ বছর বয়সী ফাইযা‌ব, ভারতের জেল থেকে ছাড়া পাবে। তিন বছর ধরে তিনি এই আশায় ছিলেন।

২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে এবং অঞ্চলটিকে সরাসরি দিল্লির নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এরপর থেকে হাজার হাজার কাশ্মীরিকে গ্রেফতার করা হয়, যারা জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। এদের মধ্যে অনেককে “সন্ত্রাসবাদে জড়িত” বা “ভারতবিরোধী” কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছে। বেশিরভাগকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আরও পড়ুন: নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী প্রধানদের পর, প্রতিরক্ষা সচিবের সঙ্গে মোদির বৈঠক

অনেক কাশ্মীরি পরিবার আশা করেছিল, নির্বাচনের মাধ্যমে একটি আঞ্চলিক সরকার গঠিত হলে বন্দিদের মুক্তির পথ খুলবে। কিন্তু গত মাসে পহেলগাঁও  হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর সেই আশা ধাক্কা খেয়েছে।এই হামলাটি গত ২৫ বছরে কাশ্মীরে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে ধরা হচ্ছে। এরপর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে।

আরও পড়ুন: ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে আজ রুদ্ধদ্বার আলোচনা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে

শাকিলা জানান, পহেলগাঁও হামলার খবর শোনার পর থেকে তিনি ভয় ও উদ্বেগে ভুগছেন। তাঁর আশঙ্কা, নতুন করে আরও ধরপাকড় শুরু হবে এবং তাঁর ছেলের মুক্তির সম্ভাবনা আরও কমে যাবে। কারণ, তাঁর ছেলে ইতিমধ্যে পহেলগাঁও হমলার সন্ত্রসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ধারায় অভিযুক্ত। তিনি বলেন, “নির্বাচনের পর আমার ছেলের মুক্তির সামান্য আশা ছিল। কিন্তু এখন সেটা মুছে গেছে। আমি মনে করি, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।”

আরও পড়ুন: তাঁর থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া উচিত দেশবাসীর নৌসেনার স্ত্রীর প্রশংসায় মেহবুবা

২০২৪ সালের বিধানসভা  নির্বাচনটি অনেক কাশ্মীরির কাছে গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার একটি সুযোগ ছিল। ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬৪ শতাংশ, যা লোকসভা নির্বাচনের থেকেও বেশি।

অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তারা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেবে বা অন্তত কাশ্মীরের জেলগুলোতে স্থানান্তর করবে। জাতীয় কনফারেন্স (এনসি) ৯০টির মধ্যে ৪২টি আসনে জিতে সরকার গঠন করে। তবে এখনও পর্যন্ত বন্দিদের মুক্তি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

শাকিলা জানান, তিনি এনসিকে ভোট দিয়েছিলেন। কারণ তারা বলেছিল বন্দিদের মুক্তির জন্য কাজ করবে। কিন্তু এখন ছয় মাস হয়ে গেলেও কিছুই করা হয়নি। “তারা আমাদের আবেগ নিয়ে খেলেছে ভোট পাওয়ার জন্য,” । ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর রাতে পুলিশের একটি দল তাঁদের বাড়িতে আসে এবং ফাইযা‌বকে গ্রেফতার করে। পুলিশ বলে, সে এক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। তাঁকে ইউএপিএ (UAPA) আইনে গ্রেফতার করা হয়, যা বিচার ছাড়াই দীর্ঘদিন আটকে রাখার সুযোগ দেয়।

প্রথমে তাকে শ্রীনগরের একটি জেলে রাখা হয়, পরে ৩০০ কিলোমিটার দূরের জম্মুতে স্থানান্তর করা হয়। শাকিলা জানান, অর্থের অভাবে তিনি আট মাস ধরে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। “আমার কোনো উপার্জনের উৎস নেই। আমার ছেলে ছিল একমাত্র ভরসা। সেই ভরসাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে,” তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, “আরও একটি ঈদ এলো আর চলে গেল, কিন্তু আমার ছেলে পাশে ছিল না। ঈদের দিন আনন্দের সময়, কিন্তু আমার জন্য সেটি কষ্টের দিন হয়ে দাঁড়ায়। আমার ঈদ হবে যেদিন আমার ছেলে মুক্ত হবে।” শাকিলার মতো অনেক পরিবার আছেন, যাঁদের প্রিয়জন কাশ্মীরের বাইরে জেলে বন্দি। অধিকাংশই আর্থিক সমস্যার কারণে তাঁদের দেখতে যেতে পারেন না।

পুলওয়ামা জেলার ২৯ বছর বয়সী ইশরাত তাঁর ২৫ বছর বয়সী ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। ২০২৩ সালের জুনে তাঁকে পিএসএ (PSA) আইনে গ্রেফতার করা হয়। এ আইনে ওয়ারেন্ট ছাড়াই কাউকে দুই বছর পর্যন্ত আটক রাখা যায়।

২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১০০-এর বেশি মানুষকে PSA-তে আটক করে কাশ্মীরের বাইরে পাঠানো হয়েছে। ২০১৯ সালের পর থেকে এই ধারা দেওয়ার পরিমান আরও বেড়েছে। ইশরাতের ভাইকে প্রথমে জম্মুতে রাখা হয়, পরে উত্তর প্রদেশের এক জেলে পাঠানো হয় – যা তাঁদের বাড়ি থেকে ১,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। তিনি বলেন, ভ্রমণের খরচের কারণে তাঁরা ভাইকে দেখতে যেতে পারেন না। ইশরাত বলেন, রমজান মাসে তাঁর ভাই ও অন্য বন্দিরা দুপুরের খাবারই ইফতার ও সেহরির জন্য রেখে দিতেন। সেলে একটি মাত্র ফ্যান রয়েছে, যা ২৫ ফুট ওপরে স্থাপিত – গরমে এটি কোনও কাজেই আসে না। “প্রতিদিনই যেন জেলের ভেতরে নরকের আগুনে দিন কাটাচ্ছে,”।

[ আরও পড়ুন: ইসরাইলি অবরোধে মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে গাজার ২,৯০,০০০ শিশু ]

তাঁদের মা, যাঁর বয়স প্রায় ৫০, ছেলের বিচ্ছেদে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। সপ্তাহে দুইবার ফোনে মাত্র ৫ মিনিটের কথোপকথনই তাঁদের একমাত্র সান্ত্বনা। ইশরাত বলেন, নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের গ্রামে এসে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বন্দিদের মুক্তি বা অন্তত কাশ্মীরে ফিরিয়ে আনার। “আমাদের পরিবার সবাই ভোট দিয়েছিল। ভেবেছিলাম নতুন সরকার কিছু করবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। মনে হচ্ছে সরকার আমাদের ভুলে গেছে,” তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, “আমার ভাই যদি অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাঁকে কাশ্মীরে বিচার করে সাজা দিন। কিন্তু হাজার কিলোমিটার দূরে পাঠানো পরিবারগুলোর জন্য অন্যায়।”

জাতীয় কনফারেন্সের মুখপাত্র ইমরান নবি দার বলেন, কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা বাতিল এবং একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে থাকা নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার কারণে সরকার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারছে না। সরকার গঠনের কিছু মাস হয়েছে মাত্র। আমাদের সামনে পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ রয়েছে, যারা গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত নন এবং যারা অন্যায়ভাবে আটক, তাদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি তাঁরা রেখেছেন।আমরা জানি পরিবারের যন্ত্রণা কতটা। আমরা তাঁদের ভুলিনি। আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এই সমস্যা সমাধান হবে। পহেলগাঁও হামলার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কাশ্মীরে নিরাপত্তা জোরদার হয়েছে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের আশঙ্কা বেড়েছে।

[ আরও পড়ুন: আমি এখন কীভাবে তোমায় জড়িয়ে ধরব মা? – ফিলিস্তিনি মাহমুদ ]

পহেলগাঁও হামলার পর হাজারের বেশি মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ৯০ জনকে পিএসএ আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেক বিদ্রোহী সন্দেহভাজনের বাড়িও ভেঙে ফেলা হয়েছে।

কাশ্মীরি অধ্যাপক ও বিশ্লেষক শেখ শওকত হুসেইন বলেন, “কাশ্মীরে বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক কারণে লোকজনের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এখন তাঁদের কাশ্মীরের বাইরে পাঠানো হচ্ছে, যা পরিবারগুলোর জন্য আরও কষ্টের।”

তিনি বলেন, এটি ভারতের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এতে কাশ্মীরিদের মধ্যে আরও বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে।

সূত্র: আল জাজিরা