বিশ্ব প্রেস ফটো পুরস্কার ২০২৫: গাজার ছোট্ট মাহমুদের ছবি বিশ্বকে কাঁদালো, গাজা থেকে ভিয়েতনাম, একটি ছবির মূল্য কত?
আমি এখন কীভাবে তোমায় জড়িয়ে ধরব মা? – ফিলিস্তিনি মাহমুদ

- আপডেট : ৩ মে ২০২৫, শনিবার
- / 159
পুবের কলম ডেস্ক: ফিলিস্তিনি আলোকচিত্রী সামার আবু এলউফ ২০২৫ সালের World Press Photo of the Year পুরস্কার জিতেছেন তাঁর তোলা এক হৃদয়বিদারক ছবির জন্য, যার শিরোনাম “Mahmoud Ajjour, Aged Nine”। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর জন্য তোলা এই ছবিতে উঠে এসেছে গাজার একটি শিশুর নির্মম বাস্তবতা, যার দুই হাতই উড়ে গেছে একটি ইসরায়েলি বিমান হামলায়।
এই ছবিতে ৯ বছর বয়সী মাহমুদের হাতবিহীন দেহ আংশিক ছায়ায় ঢাকা, কিন্তু তার চোখে ফুটে উঠেছে এক অপার শুন্যতা, ব্যথা ও প্রশ্ন। ছবিটি শুধুই আলোকচিত্র নয়, বরং একটি প্রজন্মের ওপর চাপিয়ে দেওয়া দুঃস্বপ্নের দলিল।
সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাহমুদ জানায়, যখন তার মা তাকে জানিয়েছিলেন যে তার দুই হাত কেটে গেছে, তখন সে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। “আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম, মানসিক অবস্থাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল।” পরবর্তীতে কোন ধরণের অ্যানাস্থেশিয়া ছাড়াই তাকে অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে, কারণ ইসরায়েলের অবরোধে গাজায় ওষুধ এবং চিকিৎসা সামগ্রীর অভাব মারাত্মক। মাহমুদ বলেন, “আমি সেই ব্যথা সহ্য করতে পারছিলাম না, খুব জোরে চিৎকার করছিলাম। আমার আওয়াজ পুরো হাসপাতালের করিডোর জুড়ে শোনা যাচ্ছিল।”
আলোকচিত্রী সামার জানান, শিশুটির প্রথম প্রশ্ন ছিল: “আমি এখন কীভাবে তোমায় জড়িয়ে ধরব মা?”
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত ৫২,৩৬৫-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ইউনিসেফ জানায়, আগ্রাসনের মাত্র দুই মাসের মধ্যেই গাজায় প্রায় ১,০০০ শিশু একটি বা উভয় পা হারিয়েছে।
জাতিসংঘ এপ্রিল ২০২৫-এ সতর্ক করে জানায়, গাজায় প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন শিশু নিহত বা আহত হচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মাঝে সামারের এই ছবি যেন বিশ্ববাসীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, বাস্তবে গণহত্যা দেখতে কেমন হয়।
গাজা পরিস্থিতির এই হৃদয়বিদারক চিত্র মনে করিয়ে দেয় ১৯৭২ সালের ন্যাপকাম গার্ল, কিম ফুক-এর সেই বিখ্যাত ছবিকে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের ট্রাং ব্যাং গ্রামে মার্কিন সমর্থিত হামলার পরে দগ্ধ অবস্থায় নগ্ন হয়ে দৌড়াচ্ছিলেন ৯ বছরের কিম।
ছবিটি তোলেন এপি-এর জন্য কাজ করা ভিয়েতনামি ফটোগ্রাফার নিক উট। ছবিটি ১৯৭৩ সালের World Press Photo পুরস্কার জিতেছিল এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী বিশ্বজনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।
২০২২ সালে CNN-কে কিম বলেন, “চারপাশে আগুন, পোশাক পুড়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম: ‘আমি পুড়ে গেছি, আমি কুৎসিত হয়ে যাব, মানুষ আমাকে অন্যভাবে দেখবে।’”
[আরও পড়ুন: শিক্ষা পুড়িয়ে যখন ক্ষুধার আগুন নেভানো হয়, ফিলিস্তিনি বই প্রেমির গল্প।]
তিনি আরও বলেন, ১৪ মাস হাসপাতালে থেকে শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিলেন। তাঁর দগ্ধ ও নগ্ন ছবি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে তিনি গভীর লজ্জা ও আত্মহীনতায় ভুগতেন।
ন্যাপকাম ছিল যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একাধিক বিধ্বংসী অস্ত্রের মধ্যে মাত্র একটি। আজও ভিয়েতনামে মিলছে অবিস্ফোরিত বোমা, যা মানুষের মৃত্যু ও বিকলাঙ্গতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। Agent Orange নামের রাসায়নিকও এখনও জন্মগত ত্রুটি ও মৃত্যু ঘটাচ্ছে।
সুসান সন্ট্যাগ তাঁর বই On Photography-তে লেখেন, “এমন ছবি সম্ভবত যুদ্ধবিরোধী জনমত গঠনে একশো ঘণ্টার ভিডিওর চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে।”
যুদ্ধবিরোধী জনমত সত্ত্বেও, ভিয়েতনামে মার্কিন বর্বরতা আরও তিন বছর চলেছিল। আজকের দিনে গাজার প্রতিটি ছবিই যেন The Terror of War-এর নতুন সংস্করণ।
সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত স্ক্রল করা ছবির ভিড়ে গণহত্যার দৃশ্যও যেন মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যায়। সামার আবু এলউফ এপ্রিল ১৮-এ ইনস্টাগ্রামে লেখেন, “আমি সব সময় এমন একটি ছবি তুলতে চেয়েছি, যা যুদ্ধ থামাতে পারবে। কিন্তু যদি তা না পারে, তাহলে ছবির মূল্যটাই বা কী?”
তিনি প্রশ্ন রাখেন: “আর কী ছবি দেখার অপেক্ষা করছেন আপনি, যাতে বুঝতে পারেন গাজার ভিতরে কী ঘটছে?”