দেশের তৃতীয় মুসলিম প্রধান বিচারপতি জাস্টিস এ এম আহমাদি ও তাঁর কর্মনিষ্ঠা —- একনজরে

- আপডেট : ৬ মার্চ ২০২৩, সোমবার
- / 5
বিশেষ প্রতিবেদন: ভারতের তৃতীয় মুসলিম প্রধান বিচারপতি জাস্টিস আজিজ মুশাব্বের আহমাদি ২ মার্চ, বৃহস্পতিবার সকালে নয়াদিল্লিতে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। গুজরাত হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল কর্মজীবন অতিবাহিত হয়েছে। দেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়েও তিনি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। এর বাইরে, পাঁচ দশক ধরে জনজীবনের উপর তাঁর যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
১৯৯৪ সালের ২৫ অক্টোবরে জাস্টিস আহমাদি ভারতের প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন এবং ১৯৯৭ সালের ২৪ মার্চ তিনি এই পদ থেকে অবসর নেন। তিনি ছিলেন ভারতের ছাব্বিশতম প্রধান বিচারপতি। ১৯৭৬ সাল থেকে গুজরাত হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে কর্মরত থাকার পর ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে তাঁকে সুপ্রিম কোর্টে উন্নীত করা হয়। এর আগে, গুজরাতের নিম্ন আদালতের বিচারক ছিলেন তিনি। আহমেদাবাদে নগর দেওয়ানি ও সেশন আদালতে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৩২ সালের ২৫ মার্চ গুজরাতে সুরাতে জন্ম হয় তাঁর। জাস্টিস আহমাদি এক জুনিয়র দেওয়ানি বিচারকের পুত্র। গুজরাতের বিচার বিভাগে কর্মরত থাকায় তাঁর পিতার নানা জায়গায় বদলি হত এবং সেই-মতো তিনিও পিতার হাত সঙ্গে এই রাজ্যের নানা জেলায় ও তালুকে বাস করেছেন শৈশব-কৈশোরে। পড়াশোনাও করেছেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। ১৯৫৪ সালে তিনি প্রথম আইনি পেশা শুরু করেন। আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর মুম্বইয়ে বার-এ যোগ দেন।
জাস্টিস আহমাদি হাতে গোনা কয়েকজন বিচারপতির একজন যিনি বিচার বিভাগের নিম্ন স্তর থেকে সুপ্রিম কোর্ট অবধি পৌঁছেছিলেন এবং পরে অলংকৃত করেন ভারতের প্রধান বিচারপতির পদ। সর্বোচ্চ আদালতে তাঁর সময়কালে তিনি ২৩২টি রায় লিখেছেন এবং ৮১১টি বেঞ্চের অংশ হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে, তিনি সুপ্রিম কোর্ট লিগাল এইড কমিটিতে সভাপতি হিসেবেও কাজ করেছেন। ১৯৯০-৯৪ সালের মধ্যে আইনি সহযোগিতামূলক প্রকল্প প্রয়োগ করতে তিনি এই কমিটির কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
গুজরাত হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন যখন, সেই সময় জাস্টিস আহমাদি বহু উপদেষ্টামূলক বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই বোর্ডগুলির মধ্যে ছিল মেনটেনান্স অফ সাপ্লায়েড এসেন্সিয়াল কমোডিটিজ, প্রিভেনশন অফ ব্ল্যাক মার্কেটিং, কনজারভেশন অফ ফরেন এক্সচেঞ্জ, প্রিভেনশন অফ স্মাগলিং অ্যাক্টিভিটিজ প্রভৃতি। ১৯৮৮ সালে সুপ্রিম কোর্টে উন্নীত হওয়ার ঠিক আগে তিনি রাজীব-লঙ্গোয়াল সেটেলমেন্টের অধীনে ‘রবি অ্যান্ড বিজ ওয়াটার ডিসপিউট ট্রাইবুনালে’র সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন।
ভারতের প্রধান বিচারপতিদের ইতিহাসে জাস্টিস আহমাদি ছিলেন তৃতীয় মুসলিম যিনি এমন উচ্চতায় আসীন হয়েছিলেন। তাঁর আগে, জাস্টিস এম হিদায়তুল্লাহ (১৯৬৮-১৯৭০) ও জাস্টিস এম হামিদুল্লাহ বেগ (১৯৭৭-১৯৭৮) ভারতের প্রধান বিচারপতি পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। জাস্টিস আহমাদির অবসরের পর, জাস্টিস আলতামাস কবীর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সময়কাল ছিল ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই পর্যন্ত।
সুপ্রিম কোর্টের যে সব গুরুত্বপূর্ণ রায়ের সঙ্গে জাস্টিস আহমাদি যুক্ত ছিলেন, সেগুলির মধ্যে রয়েছে ইন্দ্র সাহনি বনাম ভারত সরকারের মামলা এবং ইসমাইল ফারুকি বনাম ভারত সরকারের মামলা। ১৯৯২ সালের ইন্দ্র সাহনি মামলায় কেন্দ্র সরকারের সিদ্ধান্তকে বহাল রেখেছিল সুপ্রিম কোর্ট। কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল, মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে চাকুরিতে নিয়োগ ও শিক্ষায় ওবিসিদের জন্য আসন সংরক্ষণ চালু করতে হবে।
১৯৯৪ সালের ইসমাইল ফারুকি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, ইসলাম ধর্ম অনুশীলন করতে মসজিদ অপরিহার্য অঙ্গ নয় এবং অন্যত্র নামাজ পড়া যেতে পারে। শীর্ষ আদালত আরও জানায়, ১৯৯৩ সালে বাবরি মসজিদের সংলগ্ন জমি কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণে ভারতীয় সংবিধানে কোনও বাধা নেই।
অবসরের পর জাস্টিস আহমাদি সামাজিক পরিসরে সক্রিয় ছিলেন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ করা হয়েছিল তাঁকে। ২০০৭ সালে এই পদে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন তিন বছরের জন্য। জনসভায় কথা বলার সময় তিনি ওজনদার শব্দ প্রয়োগ করতেন। দেশে মুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার বিষয়ে দৃঢ়ভাবে সওয়াল করতেন তিনি। মুসলিম তরুণদের শিক্ষার উপর তিনি বিশেষভাবে জোর দিতেন।
প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেওয়ার অব্যবহিত পরেই এক অনুষ্ঠানে জাস্টিস আহমাদি মুসলিমদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত দিকে পিছিয়ে পড়ার সমস্যাকে সমাধান করতে সরকারি কর্তৃপক্ষের কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা নিয়ে জোরালো বক্তব্য রাখেন।
তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল,”দেশের উন্নয়নে কোনও ভাবে অবদান রাখতে অপারগ জনসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট অংশকে এভাবে ফেলে রেখে দিতে পারে না দেশ।”
২০০৮ সালে, ‘আ গাইড টু আপলিফট মাইনরিটিজ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন জাস্টিস আহমাদি। এই বইয়ের প্রকাশ-সহযোগি ছিল জামাতে ইসলামি হিন্দ। সংখ্যালঘুদের কল্যাণে যে সকল সমাজকর্মীরা কাজ করছেন তাঁদের সাহায্য ও পথনির্দেশনা দিতে এই কিতাব লিখেছিলেন তিনি। সংখ্যালঘুদের উন্নতির জন্য বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সরকারের কাছ থেকে কীভাবে সাহায্য নিয়ে তাদের নানা প্রোগ্রাম চালাতে পারে এবং অন্যান্য ফান্ডিং এজেন্সির কথা বর্ণিত হয়েছে ২০৭ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে। প্রসঙ্গত, জাস্টিস আহমাদির পুত্র হুজেফা আহমাদি সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী।