বেসমেন্টে অসহায় হাজার বাঙালি পড়ুয়া !

- আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২, শনিবার
- / 11
আবদুল ওদুদ : কিয়েভ খারকিভ সহ কয়েকটি মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে বন্দি কয়েক হাজার বাঙালী মেডিকেল পড়ুয়া । ইউক্রেন থেকে সরাসরি পুবের কলমকে জানালেন শবনম বেগম ঈশিতা রহমান মৌমি সিনহা
আকাশপথে লাগাতার চলছে বিমান হানা । যুদ্ধ চলছে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে। অথচ আতঙ্কে মুখ সাদা হয়ে রয়েছে ভারত তথা বাংলার বহু পরিবারের। এই মুহূর্তে ইউক্রেনে প্রায় ১৮ হাজার ভারতীয় ডাক্তারী পড়ুয়ারা রয়েছেন। এই ১৮ হাজার মেডিকেল পড়ুয়ার মধ্যে প্রায় এক হাজারেরও বেশি বাঙালি পড়ুয়া রয়েছেন। বাংলার বেশ কিছু মুসলিম মেয়েও পড়তে গিয়েছেন ইউক্রেনে। বহু আশা নিয়ে তাঁরা সেখানে পড়তে গিয়েছেন। অনেকে ঘটি বাটি বিক্রি করেও গিয়েছেন। তাদের সেই স্বপ্ন কি তাহলে দুই দেশের যুদ্ধে পুড়ে খাক হয়ে যাবে? এই পড়ুয়াদের কারও বাড়ি দক্ষিণ দিনাজপুর, কারও বাড়ি বীরভূম , কিংবা পশ্চিম মেদিনীপুর। এছাড়াও রয়েছে মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়ার ছাত্র -ছাত্রীরা। এদের কেউ রয়েছেন কিয়েভ খারকিভ জাইতোমির কিংবা লুস্ক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শুক্রবার সকালে কয়েকটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বেসমেন্টে থাকার ব্যবস্থা করেছে এই পড়ুয়াদের । ইউক্রেনের সীমান্ত শহর খারকিভ এ বর্তমানে ৩ হাজার ভারতীয় পড়ুয়া রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম বর্ষেই রয়েছে ১৫০ জন বাঙালী মেডিকেল পড়ুয়া । বীরভূমের রামপুর হাটের মাড়গ্রামের শবনম বেগম রয়েছেন খারকিভ ন্যাশনাল মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে। তিনি প্রথম বর্ষের ছাত্রী। গত ১৪ ফেব্রুয়ারী ইউক্রেনে পৌঁছান।
শুক্রবার তিনি পুবের কলম প্রতিনিধিকে জানান তাদের রাখা হয়েছে মেডিক্যাল কলেজের বেসমেন্টে। এই মেডিক্যাল কলেজের প্রায় ৮০০ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছেন। তাদের প্রত্যেককে রাখা হয়েছে বেসমেন্টে। তিনি বলেন খুব আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। প্রচন্ড ঠাণ্ডা। গরম জল যেটুকু ছিল শেষ হয়ে গেছে। পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা কোনও ব্যবস্থা নেই। সকলকে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে। হাতের কাছে কিছু শুকনো খাবার ছিল। সেগুলিও শেষের পথে। এখন কি হবে বুঝতে পারছেন না। খারকিভ মেডিকেলের বেসমেন্টের একটি ভিডিয়ো পুবের কলমকে পাঠিয়েছেন শবনম বেগম। তাতে দেখা যাচ্ছে ১৫০ জনের বেশি পড়ুয়া একই ঘরে রয়েছেন। কম্বল মুড়ি দিয়ে কেউ বসে আবার কেউ শুয়ে আছেন।
শবনম বেগম বলেন বিদ্যুৎ এবং মোবাইলের চার্জ নিয়ে বৃহস্পতিবার কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। এখন সেই সমস্যা নেই। তবে রাশিয়া যদি বিদ্যুৎ পাওয়ার স্টেশন এবং মোবাইল টাওয়ার ধ্বংস করে দেয়। তাহলে সকলের মৃত্যু অনিবার্য। কারণ তাদের যে ধরণের বেসমেন্টে রাখা হয়েছে তাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে শ্বাসবন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। খারকিভ ন্যাশনাল মেডিকেল ইউনির্ভর্সিটিতে পড়াশুনা করেন আরও এক বাঙালী ছাত্রী মৌমি সিনহা। পুবের কলমকে মৌমি জানান তিনি মেডিকেল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে থাকেন না। তারা আলাদা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। একটি বহুতল ভবনে। ঘর থেকে দেখতে পাচ্ছেন কীভাবে রাশিয়ার সেনারা ইউক্রেনের মাটিতে নামছে। চোখের সামনে রকেট নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তিনি বলেন এমনিতেই প্রচন্ড ঠাণ্ডা তার উপর এই হাড়হিম করা দৃশ্য দেখে শরীর আরও ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। মৌমি সিনহা বলেন রাশিয়ার বোমা বর্ষণের হাত থেকে তাদের বাঁচাতে ফ্ল্যাট কর্তৃপক্ষ একেবারে গ্রাউন্ড ফ্লোরে আশ্রয় দিয়েছে । কিন্তু প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যে রয়েছেন। তাদেরও কাছে প্রয়োজনীয় খাবার নেই। চারিদিকে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে রুশ সেনারা।
মৌমি সিনহার বাড়ি মুর্শিদাবাদের ফরাক্কার জাফরগঞ্জে। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের উপর যে আঘাত এসেছে তাতে কি হবে বুঝতে পারছেন না। বাড়ির লোকজনও দিন কাটাচ্ছেন উদ্বেগে। মৌমির ছোট বোন দিদির জন্য কান্নাকাটি করছে। এখন পর্যন্ত ফোনে যোগাযোগটুকু রয়েছে। তবে কতটুকু থাকবে তা নিয়ে সংশয় যাচ্ছে না। ভারতীয় দূতাবাস থেকে এখন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। তবে তারা নিয়মিত দূতাবাসে ইমেইল করছেন। মৌমি জানান বহু বাঙালী ছাত্রছাত্রী রয়েছে। কিছু পড়ুয়ারা পোল্যান্ড সীমান্তেও রয়েছে। তাদের পোলান্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যাতে তারা পোল্যান্ড থেকে ভারতে ফিরে আসতে পারেন।
নদীয়ার চাপড়ার আফ্রিদি রয়েছেন কিয়েভ শহরে। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁকে মেট্রো স্টেশনে রাত কাটাতে হয়েছে। আতঙ্কে হস্টেল ছেড়ে মেট্রো স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। যুদ্ধের ভয়াবহ দৃশ্য দেখে শেষ পর্যন্ত মেট্রো স্টেশনে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন। তার কাছে নেই কোন খাবার পানীয়জল। প্রচন্ড ঠান্ডায় মেট্রোয় আশ্রয় নিয়েছেন প্রাণ হাতে করে হস্টেল থেকে পালিয়ে এসেছেন। গোলাগুলির ভয়ে বাইরে পা রাখতে সাহস করছেন না।
ইশিতা রহমান রয়েছেন কিয়েভ মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে। বৃহস্পতিবার থেকে তাদেরও ইউনিভার্সিটির বেসমেন্টে রাখা হয়েছে । খাবার সংকটে রয়েছেন তাঁরাও। দুশ্চিন্তায় রয়েছেন আদৌ কি দেশে ফিরতে পারবেন? ভারতীয় দূতাবাস থেকে এখন কেউ খবর নেয়নি । বার বার মেইল করা সত্ত্বেও কোনও উত্তর পাননি। অনাহার আর উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন তাঁরা। যা খাবার ছিল সব শেষ হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার কিছু খাবার পেলেও আগামী দিনে কি হবে সেই নিয়ে উৎকণ্ঠায় কাটছে দিন। তিনি বলেন বাবা – মা আশা করে বিদেশে পাঠিয়ে ছিলেন মেডিক্যাল পড়তে কিন্তু সেই স্বপ্ন কতদূর এগোবে বুঝতে পারছেন না।
রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেনের মাটি দখল করছে তাতে তাদের স্বপ্ন রাশিয়ার মিশাইলের মতই মিলিয়ে যাবে না তো? একদিকে নিজ দেশের পরিবার এবং অপরদিকে আগামীর ভবিষ্যত নিয়ে বাঙ্কারের মধ্যে বন্দী রয়েছেন । ইশিতা রহমানের বাবা আবদুর রহমান পেশায় এলআইসির এজেন্ট পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম থেকে লোন নিয়ে পড়তে পাঠিয়েছেন। মেয়ে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। এখন পর্যন্ত কেউ যোগাযোগ করেনি। মেয়েকে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন আপনিই পারেন ঈশিতার মতো বাংলার কয়েকশো মেডিকেল পড়ুয়ার ফিরিয়ে আনতে। মুখ্যমন্ত্রী কাছে তিনি কাতর আবেদন জানান।
কিয়েভ মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে রয়েছেন বীরভূমের মিসবাউদ্দিন, নাজিয়া খাতুন। তাঁরাও উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। মিসবাউদ্দিন বলেন তাদের সঙ্গেও ভারতীয় দূতাবাসের তরফে কেউ যোগাযোগ করেনি। মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ফলে কি হবে বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন বাড়ির লোকও উদ্বিগ্ন। জমিজমা বিক্রি করে বাবা মা ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছিলেন। এখন যদি ডাক্তারি পড়া না হয় তাহলে জীবনটাই তো নদীর জলের মতো ভেসে যাবে । আর ভেঙে খান খান হয়ে যাবে স্বপ্ন ।