রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে ইসলামদর্শন

- আপডেট : ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার
- / 51
সাহানারা খাতুন
“রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পুজো নয়, ঠাকুর দেবতার মত অঞ্জলিও নয়, আবেগের স্পর্শে রবীন্দ্রনাথ বিরাজ করুন সত্যের গভীরে , রবীন্দ্রনাথ থাকুন চেতনার স্তরে, পাঠকের অন্তরে অন্তরে!
কবিগুরু কে নিয়ে’ দেড়শ কবির দেড়শ কবিতায়’ সম্পাদকীয়তে এমন স্পষ্ট কথাগুলো আজ কবির ১৬৫ তম জন্মজয়ন্তীতে বড্ড বেশি করে মনে পড়ছে! ভারত পাকিস্তান সংকট যখন আমাদের শিরায় শিরায় আতঙ্কের জন্ম দিচ্ছে, আমাদের জীবন বিপন্ন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিশ্চিত নিরাপদ সুন্দর সময় উপহার দিতে পারছিনা,সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কে বা কারা যেন ঘরে ঘরে রবীন্দ্রনাথকে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে সুগোপনে! অথচ হিন্দু রবীন্দ্রনাথ, মুসলমান রবীন্দ্রনাথ,খ্রিস্টান রবীন্দ্রনাথ বলে কিছুই হয় না! রবীন্দ্রনাথ আসলে সবার, রবির আলো যেমন সবার উপরে ছড়ায় তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শ ছিল সার্বজনীন! তাই কোন এক পঁচিশে বৈশাখের দিনে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য উচ্চারণ করেছিলেন
“আমার প্রার্থনা শোনো ২৫শে বৈশাখ আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের
হতাশা স্তব্ধ বাক্যে ভাষা চাই আমরা নির্বাক
পাঠাব মৈত্রীর বাণী সারা পৃথিবীকে জানি ফের ”
বর্তমান বিভেদের রাজনীতিতে যেখানে মানুষ নয় ধর্ম বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথের ভারত তীর্থ কবিতা মহামিলনের মন্ত্র হিসেবে কেন গ্রহণ করছি না? ধর্মের নামে খাদ্য পোশাক এমন কি স্বাভাবিক জীবন যাপনের অভ্যাস ব্যহত হচ্ছে সেখানে রবীন্দ্রনাথের দর্শন কেন আঁকড়ে ধরছি না? সব জাতির সব স্তরের মানুষ যার কাছে সমাদৃত হতো তাঁকে কেন শুধু একদিনের উৎসবে পূজা করছি, কেন দৈনিক জীবনে তাকে স্মরণ করছি না? তিনি লিখেছিলেন “হেথায় দাঁড়ায়ে দুবাহু বাড়ায়ে নমি নর দেবতারে
উদার ছন্দে পরমানন্দে বন্দন করি তারে ”
তিনি ছিলেন সব ধর্মের পূজারী।
ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা একজন খাঁটি মুসলমানের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। হযরত মুহাম্মদকে তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব দের মধ্যে আখ্যায়িত করেছিলেন। ইসলামকে তিনি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্যকে তিনি স্বীকার করেছেন শুধু নয় তিনি সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব ও সহাবস্থান স্থাপন করতে আজীবন লিখে গেছেন সে কথা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন লেখায় তিনি মুসলিম সংস্কৃতি বা মুসলমান ব্যক্তিবর্গের শ্রদ্ধা করেছেন শুধু নয় গভীর বন্ধুত্ব স্থাপন করেছেন এমন উদাহরণও বহু আছে ! শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের তিনি স্থান দিয়েছিলেন। ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পর পরই তিনি বিখ্যাত লেখক মুজতবা আলী সহ মুসলিম অনেক ছাত্রদের ভর্তি করিয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারির পবিত্র ঈদে এক শুভেচ্ছা বাণীতে তিনি হযরত মুহাম্মদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ” যিনি মহোত্তম এর মধ্যে অন্যতম সেই পবিত্র পায়গম্বর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদ্দেশ্যে আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। মানুষের ইতিহাসে এক নতুন সম্ভাবনার জীবন শক্তির সঞ্চার করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ। তিনি এনে ছিলেন নিখাদ শুদ্ধ ধর্মাচরণের আদর্শ ” এছাড়াও মুসলমান কবি লেখক বুদ্ধিজীবীদের সাথে ছিল রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্বপূর্ণ ভালোবাসা। কবির মুসলমান ভাড়াটেদের( যখন পারিবারিক সম্পত্তি পরিচালনা করার সময় শিলাইদহে থাকতেন) দুঃখ কষ্ট লাঘবের জন্য খুবই সহানুভূতিশীল পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এজন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও সমালোচিত হয়েছিলেন । মুসলমানদের প্রতি অন্তর্নিহিত পক্ষপাতিত্ব করেন বলে বদনাম করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছিলেন ” ঠাকুর রচিত বিশাল সাহিত্যে আমরা ইসলামের প্রতি কোন বিদ্বেষ খুঁজে পাইনি বরং তার লেখা এত বেশি ইসলামী বিষয়বস্তু এবং আদর্শ রয়েছে যে তাকে নিঃসন্দেহে একজন মুসলমান বলা যেতে পারে’। রবীন্দ্রনাথের নৌকা চালক আব্দুল মাঝি ও তার তিন হাজারের বেশি মুসলমান ভাড়াটে তাদের জীবনধারা, ঐতিহ্য ও আদর্শকে উপলব্ধ করতে পেরেছিলেন তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ। এছাড়াও ইরান ইরাকে থাকাকালীন ইসলামিক সভ্যতার প্রচুর প্রশংসা করেছিলেন কবি। ঠাকুর পরিবারে অনেকেই জিব্বা পড়তেন মুসলমান ধরনের। ১০ বছর বয়সে কবি নিজে জিব্বা পরে ছবি তুলেছিলেন সে ছবি আমাদের খুবই চেনা। ইসলামী একেশ্বরবাদী আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত একটি প্রগতিশীল হিন্দু সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই কবির প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আরবি ফারসি সবই ছিল। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আব্দুল ওয়াদুদ, গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ মুজতবা আলী, বন্দে আলী মিয়া, সুফিয়া কামালের মত অগণিত সাহিত্যিকদের সাথে রবীন্দ্রনাথের সুন্দর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
কবির জীবনের শেষ সময়ে লেখা গল্পের নাম ‘মুসলমানের গল্প’। মৃত্যুর কিছু সপ্তাহ আগে তার জীবনের উপলব্ধিতে লেখা এই গল্পে প্রধান চরিত্র ছিল হাবির খাঁ। তার গল্পের মূল কথা ছিল হিন্দু ধর্মের জাতপাতের সমালোচনার সাথে মুসলমানদের উদারতার কথা । ইসলাম সামাজিক বৈষম্য ও সংকীর্ণতার উপরে এ কথা তিনি প্রমাণ করেন জীবনের শেষ লগ্নে এসে এই গল্পের মধ্যে। এখানেই কবি রবীন্দ্রনাথের ইসলাম দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা। যা বর্তমানে খুবই অনুকরণ এবং অনুসরণ এর দাবি রাখে। শুধু পঁচিশে বৈশাখে নয় রবীন্দ্রনাথের আদর্শ ও দর্শনকে যাপন করা প্রয়োজন প্রতিদিন প্রতিনিয়ত।