২২ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সুপ্রিম কোর্টে চলছে ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বৈধতা নিয়ে শুনানি, রইল ঝলক

আবুল খায়ের
  • আপডেট : ২০ মে ২০২৫, মঙ্গলবার
  • / 105

পুবের কলম, ওয়েব ডেস্কঃ সুপ্রিম কোর্টে চলছে ওয়াকফ আইন মামলা। কেন্দ্রের আনা নতুন ওয়াকফ আইনে শীর্ষ আদালত স্থগিতাদেশ জারি করে কি না সে দিকেই গোটা দেশের নজর। মামলা শুনছে প্রধান বিচারপতি বিআর গভই এবং বিচারপতি অগাস্টিন জর্জ মাসিহর বেঞ্চ। সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে মামলার গত বৃহস্পতিবার শুনানির কথা ছিল সুপ্রিম কোর্টে। তবে ওই দিন শুনানি হয়নি। কেন্দ্রের আর্জিতে শুনানির দিন পিছিয়ে মঙ্গলবার করা হয়। তবে গত বৃহস্পতিবারই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছিল, সংশোধিত ওয়াকফ আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে শুনানি হবে মঙ্গলবার। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি গভই এবং বিচারপতি মাসিহ্‌র বেঞ্চে সংশোধিত ওয়াকফ আইন সংক্রান্ত মামলার শুনানি শুরু হয়। পূর্বে যে তিনটি বিষয়ের উপর কেন্দ্র হলফনামা জমা দিয়েছে, সেই বিষয়গুলির উপরেই মামলাকে সীমিত রাখার অনুরোধ করেন সলিসিটর জেনারেল। যদিও তাতে আপত্তি জানান মামলাকারী পক্ষের আইনজীবী কপিল সিব্বল, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভিরা। আইনজীবী কপিল সিব্বল বলেন, এটি সম্পূর্ণ ওয়াকফ দখলের মামলা।সিব্বল বলেন, আইনটি ওয়াকফ সম্পত্তিকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু ওয়াকফ সম্পত্তিকে দখল করার জন্য আইনটি তৈরি হয়েছে। আইনটি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে কোনও প্রক্রিয়া ছাড়াই ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া যায়। তাঁর বক্তব্য, ওয়াকফ সম্পত্তি হল দান করা সম্পত্তি। এটি অন্য কাউকে হস্তান্তর করা যায় না। এক বার যেটি ওয়াকফ সম্পত্তি হয়ে যায়, সেটি ওয়াকফই থাকে।

আইনজীবী মেহেতা বলেন, ১) আদালত কর্তৃক ওয়াকফ হিসাবে ঘোষিত সম্পত্তিগুলিকে ওয়াকফ হিসাবে বাতিল করা উচিত নয়। সেগুলি ওয়াকফ ব্যবহারকারীর দ্বারা হোক বা ওয়াকফ-ডিডের মাধ্যমে হোক। আদালত যখন বিষয়টি নিয়ে বিচার করছে।

২) সংশোধনী আইনের শর্তাবলী, কালেক্টর যখন সম্পত্তিটি সরকারি জমি কিনা তা তদন্ত করছেন, তখন ওয়াকফ সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসেবে গণ্য করা হবে না এবং সেটা কার্যকর হবে না

৩) ওয়াকফ বোর্ড এবং কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের সকল সদস্যকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে, পদাধিকারবলে সদস্য ছাড়া।

সিব্বল এবং অন্যরা মেহতার এই কথায় আপত্তি জানান।

তুষার মেহতা বলেন, সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের ইঙ্গিতের পর, কেন্দ্র ওয়াকফ সংশোধনীতে রাজি। অমুসলিমদের নিয়োগ করবে না, ঘোষিত ওয়াকফের উপর স্থিতাবস্থার পর। আদালত তিনটি বিষয় নির্ধারণ করেছিল। আমরা এই তিনটি বিষয়ে আমাদের বক্তব্য জানিয়েছি। এই তিনটি বিষয়ের জবাবে আমি আমার হলফনামা দাখিল করেছি। আমার অনুরোধ হল, বিচার প্রক্রিয়া এই তিনটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখা হোক। মামলা চলাকালীন আমরা সবাই উপস্থিত ছিলাম, এই বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়েছিল।

প্রধান বিচারপতি গভই বলেন, রেকর্ডে যা আছে তা আমাদের মেনে চলতে হবে।

এরপর সিব্বল বলেন সরকার নিজস্ব পদ্ধতি নির্ধারণ করে, যে কেউ তার বিরোধিতা করতে পারে। এটা একটা দিক। দুই, ওয়াকফ কী? এটি আল্লাহর (ঈশ্বরের) প্রতিদান। একবার ওয়াকফে হস্তান্তর করলে তা সর্বদা ওয়াকফই থাকবে। কারণ, আমাদের সংবিধানের অধীনে, রাষ্ট্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে অর্থায়ন করতে পারবে না। মসজিদ থাকলে রাষ্ট্র অর্থায়ন করতে পারবে না। যদি কবরস্থান থাকে, তাহলে তা ব্যক্তিগত সম্পত্তি দিয়ে তৈরি করতে হবে। তার থেকে কোনও আর্থিক উপার্জন নেই, মানুষ তাদের প্রিয়জনদের কবর দিতে আসে। এগুলো দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সম্পত্তি দান প্রসঙ্গে সিব্বলের বক্তব্য শুনে প্রধান বিচারপতি গবই বলেন, “এমনটা তো মন্দিরেও হয়। আমি দরগায় যাই, সেখানেও এমন হয়।”

সিব্বল বলেন, দরগা এবং মসজিদ আলাদা, এই সম্পত্তিগুলি সংরক্ষণের জন্য এটি সম্প্রদায়ের মাধ্যমে হতে হবে। তারা বলে যদি দখলদারিত্ব হয়, তাহলে ওয়াকফের প্রকৃতি বদলে যায়। ১৯১৩, ১৯২৩, ১৯৫৪, ১৯৮৪, ১৯৯৫ এবং ২০১৩ এবং ২০২৫-এর ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায়।

মেহতা জানান, ২০২৫ হল ওয়াকফের সংশোধনী।

সিব্বল পাল্টা বলেন, ২০২৫ হল পূর্বের বিষয়গুলিকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে।

দুটি ধারণা,

১) ব্যবহারকারীর দ্বারা ওয়াকফ ।

২) যদি আপনি উৎসর্গ করেন এবং সম্পত্তি উৎসর্গের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাহলে ব্যবহারকারীর দ্বারা সেটি ওয়াকফ হয়ে যায়।

কিন্তু সংশোধনী আইনে তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এটি সম্পূর্ণ বাবরি মসজিদে স্বীকৃত ধারণা। কেন্দ্র বলছে পূর্ববর্তী আইনের সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। যদি ওয়াকফ সম্পত্তি রেজিস্ট্রি না হয়ে থাকে তা হলে ওয়াকফ হিসেবে গণ্য হবে না। ১০০, ২০০ এবং ৫০০ বছর আগে অনেকেই ওয়াকফের সম্পত্তি দান করেছিলেন।

আগের আইনের থেকে বর্তমানের আইনের ফারাক বোঝাতে গিয়ে সিব্বল জানান, কোনও প্রাচীন সৌধকে সংরক্ষিত করা হলেও সেটির পরিচয় বদল করা হয়নি আগে। যেটি ওয়াকফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত ছিল, সেটি তেমনই রাখা হয়েছিল। সেটিকে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। সে কথা শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, “খাজুরাহো মন্দির একটি প্রাচীন সৌধ হিসাবে সংরক্ষিত রয়েছে। তবু লোকে সেখানে প্রার্থনা করতে যায়।” প্রধান বিচারপতি গবইয়ের প্রশ্ন, “এটি কি আপনার প্রার্থনার অধিকার কেড়ে নিতে পারে?” এই প্রশ্নের জবাবে সিব্বল জানান, ১৯৫৮ সাল অনুসারে যেগুলিকে প্রাচীর সৌধ বা সংরক্ষিত হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলি আর নতুন আইন অনুসারে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য না হলে সেখানে প্রার্থনা করা যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন করেন, ওয়াকফ সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনের জন্য কি কোনও বাধ্যবাধকতা আছে?

সিব্বল জানান, ছিল, কিন্তু রেজিস্ট্রি না করার জন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

প্রধান বিচারপতি আবার জিজ্ঞাসা করেন, রেজিস্ট্রেশন কি বাধ্যতামূলক ছিল?

সিব্বল বলেন, হতে পারে। রেজিস্ট্রেশন না করলে ওয়াকফের প্রকৃতি পরিবর্তিত হবে। ওয়াকফ হিসাবে বিবেচিত হবে না এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হত না।

আগের আইনের থেকে বর্তমানের আইনের ফারাক বোঝাতে গিয়ে সিব্বল জানান, কোনও প্রাচীন সৌধকে সংরক্ষিত করা হলেও সেটির পরিচয় বদল করা হয়নি আগে। যেটি ওয়াকফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত ছিল, সেটি তেমনই রাখা হয়েছিল। সেটিকে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। সে কথা শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, “খাজুরাহো মন্দির একটি প্রাচীন সৌধ হিসাবে সংরক্ষিত রয়েছে। তবু লোকে সেখানে প্রার্থনা করতে যায়।” প্রধান বিচারপতি গবইয়ের প্রশ্ন, “এটি কি আপনার প্রার্থনার অধিকার কেড়ে নিতে পারে?” এই প্রশ্নের জবাবে সিব্বল জানান, ১৯৫৮ সাল অনুসারে যেগুলিকে প্রাচীর সৌধ বা সংরক্ষিত হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলি আর নতুন আইন অনুসারে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য না হলে সেখানে প্রার্থনা করা যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

শুনানিতে সিব্বল জানান, এই আইনের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের সিংহভাগ সদস্যকেই অমুসলিম রাখার কথা বলা হচ্ছে। নতুন আইনের ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কাউন্সিলে মুসলিম সদস্য থাকবেন ১০ জন এবং অমুসলিম সদস্য থাকবেন ১২ জন। আগে সকলেই মুসলিম ছিলেন।

 

সিব্বলের বক্তব্য, “নতুন আইন অনুসারে ওয়াকফকে সম্পত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত চাপানো হয়েছে যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সম্পত্তি দানের আগে পাঁচ বছর মুসলিম ধর্ম পালন করতে হবে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কে নেবেন? যদি কেউ মৃত্যুশয্যায় শায়িত থাকেন এবং ওয়াকফকে সম্পত্তি দান করতে চান, তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি মুসলিম ধর্ম পালন করছেন! এটি তো অসাংবিধানিক।”

শুনানির একটি পর্যায়ে সিব্বল জানান,  ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না ওয়াকফ সংক্রান্ত আগের আইনগুলিতে। কিন্তু ২০২৫ সালের নতুন আইনে সেটি সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে বলে জানান সিব্বল।

বিরতির পর প্রধান বিচারপতির এজলাস বসলে আবার সওয়াল শুরু করেন সিব্বল। আদালতে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া একটি তালিকা দেখিয়ে তিনি বলেন, “একবার সম্পত্তিগুলি সংরক্ষিত হয়ে গেলে সেগুলির আর ওয়াকফ বলে বিবেচিত হবে না। এর মধ্যে সম্ভলের জামা মসজিদও রয়েছে। কোথাও কোনও দ্বন্দ্ব তৈরি হলেই সেটিকে আর ওয়াকফ বলে বিবেচনা হবে না। যে তালিকাটি রয়েছে সেটিও সম্পূর্ণ নয়।” পাশাপাশি নতুন আইনের ৩ডি এবং ৩ই ধারায় যেগুলি উল্লেখ রয়েছে, সেটি প্রকৃত বিলে উল্লেখ ছিল না বলেও দাবি সিব্বলের। তাঁর বক্তব্য, যৌথ সংসদীয় কমিটিতেও এগুলি নিয়ে আলোচনা হয়নি।

আইনের দু’টি ধারার প্রসঙ্গে সিব্বলের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি গবই জানতে চান, সংসদেও এই নিয়ে আলোচনা হয়নি? বিচারপতি মাসিহও বলেন, “সংসদে তো ভোটাভুটি হয়েছিল”। তখন সিব্বল জানান, নিশ্চয়ই ভোটাভুটির ঠিক আগে এটি যুক্ত করা হয়েছিল।

আইনের দু’টি ধারার প্রসঙ্গে সিব্বলের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি গবই জানতে চান, সংসদেও এই নিয়ে আলোচনা হয়নি? বিচারপতি মাসিহও বলেন, “সংসদে তো ভোটাভুটি হয়েছিল”। তখন সিব্বল জানান, নিশ্চয়ই ভোটাভুটির ঠিক আগে এটি যুক্ত করা হয়েছিল।

সিব্বলের সওয়ালের রেশ ধরেই সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রশ্ন তোলেন মামলাকারী পক্ষের অপর আইনজীবী রাজীব ধাওয়ান। তাঁর বক্তব্য, ধর্মীয় সম্পত্তির বিষয়ে এ ভাবে ব্যাখ্যা আগে কখনও করা হয়নি। তিনি বলেন, “ব্রিটিশেরাও ধর্মীয় সম্পত্তির সংজ্ঞা পরিবর্তন করেনি। ওয়াকফের ধারণার এই ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ কী ছিল?”

ধওয়ান বলেন,  “আমরা এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বাস করি। আমার এক মক্কেল আছেন, তিনি শিখ। তিনি বলছেন, ওয়াকফে সম্পত্তি দিতে চান। আমি আশা করি ওই সম্মত্তি কেড়ে নেওয়া হবে না।”

Tag :

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

সুপ্রিম কোর্টে চলছে ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বৈধতা নিয়ে শুনানি, রইল ঝলক

আপডেট : ২০ মে ২০২৫, মঙ্গলবার

পুবের কলম, ওয়েব ডেস্কঃ সুপ্রিম কোর্টে চলছে ওয়াকফ আইন মামলা। কেন্দ্রের আনা নতুন ওয়াকফ আইনে শীর্ষ আদালত স্থগিতাদেশ জারি করে কি না সে দিকেই গোটা দেশের নজর। মামলা শুনছে প্রধান বিচারপতি বিআর গভই এবং বিচারপতি অগাস্টিন জর্জ মাসিহর বেঞ্চ। সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে মামলার গত বৃহস্পতিবার শুনানির কথা ছিল সুপ্রিম কোর্টে। তবে ওই দিন শুনানি হয়নি। কেন্দ্রের আর্জিতে শুনানির দিন পিছিয়ে মঙ্গলবার করা হয়। তবে গত বৃহস্পতিবারই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছিল, সংশোধিত ওয়াকফ আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে শুনানি হবে মঙ্গলবার। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি গভই এবং বিচারপতি মাসিহ্‌র বেঞ্চে সংশোধিত ওয়াকফ আইন সংক্রান্ত মামলার শুনানি শুরু হয়। পূর্বে যে তিনটি বিষয়ের উপর কেন্দ্র হলফনামা জমা দিয়েছে, সেই বিষয়গুলির উপরেই মামলাকে সীমিত রাখার অনুরোধ করেন সলিসিটর জেনারেল। যদিও তাতে আপত্তি জানান মামলাকারী পক্ষের আইনজীবী কপিল সিব্বল, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভিরা। আইনজীবী কপিল সিব্বল বলেন, এটি সম্পূর্ণ ওয়াকফ দখলের মামলা।সিব্বল বলেন, আইনটি ওয়াকফ সম্পত্তিকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু ওয়াকফ সম্পত্তিকে দখল করার জন্য আইনটি তৈরি হয়েছে। আইনটি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে কোনও প্রক্রিয়া ছাড়াই ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া যায়। তাঁর বক্তব্য, ওয়াকফ সম্পত্তি হল দান করা সম্পত্তি। এটি অন্য কাউকে হস্তান্তর করা যায় না। এক বার যেটি ওয়াকফ সম্পত্তি হয়ে যায়, সেটি ওয়াকফই থাকে।

আইনজীবী মেহেতা বলেন, ১) আদালত কর্তৃক ওয়াকফ হিসাবে ঘোষিত সম্পত্তিগুলিকে ওয়াকফ হিসাবে বাতিল করা উচিত নয়। সেগুলি ওয়াকফ ব্যবহারকারীর দ্বারা হোক বা ওয়াকফ-ডিডের মাধ্যমে হোক। আদালত যখন বিষয়টি নিয়ে বিচার করছে।

২) সংশোধনী আইনের শর্তাবলী, কালেক্টর যখন সম্পত্তিটি সরকারি জমি কিনা তা তদন্ত করছেন, তখন ওয়াকফ সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসেবে গণ্য করা হবে না এবং সেটা কার্যকর হবে না

৩) ওয়াকফ বোর্ড এবং কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের সকল সদস্যকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে, পদাধিকারবলে সদস্য ছাড়া।

সিব্বল এবং অন্যরা মেহতার এই কথায় আপত্তি জানান।

তুষার মেহতা বলেন, সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের ইঙ্গিতের পর, কেন্দ্র ওয়াকফ সংশোধনীতে রাজি। অমুসলিমদের নিয়োগ করবে না, ঘোষিত ওয়াকফের উপর স্থিতাবস্থার পর। আদালত তিনটি বিষয় নির্ধারণ করেছিল। আমরা এই তিনটি বিষয়ে আমাদের বক্তব্য জানিয়েছি। এই তিনটি বিষয়ের জবাবে আমি আমার হলফনামা দাখিল করেছি। আমার অনুরোধ হল, বিচার প্রক্রিয়া এই তিনটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখা হোক। মামলা চলাকালীন আমরা সবাই উপস্থিত ছিলাম, এই বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়েছিল।

প্রধান বিচারপতি গভই বলেন, রেকর্ডে যা আছে তা আমাদের মেনে চলতে হবে।

এরপর সিব্বল বলেন সরকার নিজস্ব পদ্ধতি নির্ধারণ করে, যে কেউ তার বিরোধিতা করতে পারে। এটা একটা দিক। দুই, ওয়াকফ কী? এটি আল্লাহর (ঈশ্বরের) প্রতিদান। একবার ওয়াকফে হস্তান্তর করলে তা সর্বদা ওয়াকফই থাকবে। কারণ, আমাদের সংবিধানের অধীনে, রাষ্ট্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে অর্থায়ন করতে পারবে না। মসজিদ থাকলে রাষ্ট্র অর্থায়ন করতে পারবে না। যদি কবরস্থান থাকে, তাহলে তা ব্যক্তিগত সম্পত্তি দিয়ে তৈরি করতে হবে। তার থেকে কোনও আর্থিক উপার্জন নেই, মানুষ তাদের প্রিয়জনদের কবর দিতে আসে। এগুলো দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সম্পত্তি দান প্রসঙ্গে সিব্বলের বক্তব্য শুনে প্রধান বিচারপতি গবই বলেন, “এমনটা তো মন্দিরেও হয়। আমি দরগায় যাই, সেখানেও এমন হয়।”

সিব্বল বলেন, দরগা এবং মসজিদ আলাদা, এই সম্পত্তিগুলি সংরক্ষণের জন্য এটি সম্প্রদায়ের মাধ্যমে হতে হবে। তারা বলে যদি দখলদারিত্ব হয়, তাহলে ওয়াকফের প্রকৃতি বদলে যায়। ১৯১৩, ১৯২৩, ১৯৫৪, ১৯৮৪, ১৯৯৫ এবং ২০১৩ এবং ২০২৫-এর ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায়।

মেহতা জানান, ২০২৫ হল ওয়াকফের সংশোধনী।

সিব্বল পাল্টা বলেন, ২০২৫ হল পূর্বের বিষয়গুলিকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে।

দুটি ধারণা,

১) ব্যবহারকারীর দ্বারা ওয়াকফ ।

২) যদি আপনি উৎসর্গ করেন এবং সম্পত্তি উৎসর্গের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাহলে ব্যবহারকারীর দ্বারা সেটি ওয়াকফ হয়ে যায়।

কিন্তু সংশোধনী আইনে তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এটি সম্পূর্ণ বাবরি মসজিদে স্বীকৃত ধারণা। কেন্দ্র বলছে পূর্ববর্তী আইনের সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। যদি ওয়াকফ সম্পত্তি রেজিস্ট্রি না হয়ে থাকে তা হলে ওয়াকফ হিসেবে গণ্য হবে না। ১০০, ২০০ এবং ৫০০ বছর আগে অনেকেই ওয়াকফের সম্পত্তি দান করেছিলেন।

আগের আইনের থেকে বর্তমানের আইনের ফারাক বোঝাতে গিয়ে সিব্বল জানান, কোনও প্রাচীন সৌধকে সংরক্ষিত করা হলেও সেটির পরিচয় বদল করা হয়নি আগে। যেটি ওয়াকফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত ছিল, সেটি তেমনই রাখা হয়েছিল। সেটিকে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। সে কথা শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, “খাজুরাহো মন্দির একটি প্রাচীন সৌধ হিসাবে সংরক্ষিত রয়েছে। তবু লোকে সেখানে প্রার্থনা করতে যায়।” প্রধান বিচারপতি গবইয়ের প্রশ্ন, “এটি কি আপনার প্রার্থনার অধিকার কেড়ে নিতে পারে?” এই প্রশ্নের জবাবে সিব্বল জানান, ১৯৫৮ সাল অনুসারে যেগুলিকে প্রাচীর সৌধ বা সংরক্ষিত হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলি আর নতুন আইন অনুসারে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য না হলে সেখানে প্রার্থনা করা যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন করেন, ওয়াকফ সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনের জন্য কি কোনও বাধ্যবাধকতা আছে?

সিব্বল জানান, ছিল, কিন্তু রেজিস্ট্রি না করার জন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

প্রধান বিচারপতি আবার জিজ্ঞাসা করেন, রেজিস্ট্রেশন কি বাধ্যতামূলক ছিল?

সিব্বল বলেন, হতে পারে। রেজিস্ট্রেশন না করলে ওয়াকফের প্রকৃতি পরিবর্তিত হবে। ওয়াকফ হিসাবে বিবেচিত হবে না এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হত না।

আগের আইনের থেকে বর্তমানের আইনের ফারাক বোঝাতে গিয়ে সিব্বল জানান, কোনও প্রাচীন সৌধকে সংরক্ষিত করা হলেও সেটির পরিচয় বদল করা হয়নি আগে। যেটি ওয়াকফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত ছিল, সেটি তেমনই রাখা হয়েছিল। সেটিকে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। সে কথা শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, “খাজুরাহো মন্দির একটি প্রাচীন সৌধ হিসাবে সংরক্ষিত রয়েছে। তবু লোকে সেখানে প্রার্থনা করতে যায়।” প্রধান বিচারপতি গবইয়ের প্রশ্ন, “এটি কি আপনার প্রার্থনার অধিকার কেড়ে নিতে পারে?” এই প্রশ্নের জবাবে সিব্বল জানান, ১৯৫৮ সাল অনুসারে যেগুলিকে প্রাচীর সৌধ বা সংরক্ষিত হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলি আর নতুন আইন অনুসারে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য না হলে সেখানে প্রার্থনা করা যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

শুনানিতে সিব্বল জানান, এই আইনের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের সিংহভাগ সদস্যকেই অমুসলিম রাখার কথা বলা হচ্ছে। নতুন আইনের ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কাউন্সিলে মুসলিম সদস্য থাকবেন ১০ জন এবং অমুসলিম সদস্য থাকবেন ১২ জন। আগে সকলেই মুসলিম ছিলেন।

 

সিব্বলের বক্তব্য, “নতুন আইন অনুসারে ওয়াকফকে সম্পত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত চাপানো হয়েছে যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সম্পত্তি দানের আগে পাঁচ বছর মুসলিম ধর্ম পালন করতে হবে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কে নেবেন? যদি কেউ মৃত্যুশয্যায় শায়িত থাকেন এবং ওয়াকফকে সম্পত্তি দান করতে চান, তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি মুসলিম ধর্ম পালন করছেন! এটি তো অসাংবিধানিক।”

শুনানির একটি পর্যায়ে সিব্বল জানান,  ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না ওয়াকফ সংক্রান্ত আগের আইনগুলিতে। কিন্তু ২০২৫ সালের নতুন আইনে সেটি সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে বলে জানান সিব্বল।

বিরতির পর প্রধান বিচারপতির এজলাস বসলে আবার সওয়াল শুরু করেন সিব্বল। আদালতে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া একটি তালিকা দেখিয়ে তিনি বলেন, “একবার সম্পত্তিগুলি সংরক্ষিত হয়ে গেলে সেগুলির আর ওয়াকফ বলে বিবেচিত হবে না। এর মধ্যে সম্ভলের জামা মসজিদও রয়েছে। কোথাও কোনও দ্বন্দ্ব তৈরি হলেই সেটিকে আর ওয়াকফ বলে বিবেচনা হবে না। যে তালিকাটি রয়েছে সেটিও সম্পূর্ণ নয়।” পাশাপাশি নতুন আইনের ৩ডি এবং ৩ই ধারায় যেগুলি উল্লেখ রয়েছে, সেটি প্রকৃত বিলে উল্লেখ ছিল না বলেও দাবি সিব্বলের। তাঁর বক্তব্য, যৌথ সংসদীয় কমিটিতেও এগুলি নিয়ে আলোচনা হয়নি।

আইনের দু’টি ধারার প্রসঙ্গে সিব্বলের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি গবই জানতে চান, সংসদেও এই নিয়ে আলোচনা হয়নি? বিচারপতি মাসিহও বলেন, “সংসদে তো ভোটাভুটি হয়েছিল”। তখন সিব্বল জানান, নিশ্চয়ই ভোটাভুটির ঠিক আগে এটি যুক্ত করা হয়েছিল।

আইনের দু’টি ধারার প্রসঙ্গে সিব্বলের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি গবই জানতে চান, সংসদেও এই নিয়ে আলোচনা হয়নি? বিচারপতি মাসিহও বলেন, “সংসদে তো ভোটাভুটি হয়েছিল”। তখন সিব্বল জানান, নিশ্চয়ই ভোটাভুটির ঠিক আগে এটি যুক্ত করা হয়েছিল।

সিব্বলের সওয়ালের রেশ ধরেই সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রশ্ন তোলেন মামলাকারী পক্ষের অপর আইনজীবী রাজীব ধাওয়ান। তাঁর বক্তব্য, ধর্মীয় সম্পত্তির বিষয়ে এ ভাবে ব্যাখ্যা আগে কখনও করা হয়নি। তিনি বলেন, “ব্রিটিশেরাও ধর্মীয় সম্পত্তির সংজ্ঞা পরিবর্তন করেনি। ওয়াকফের ধারণার এই ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ কী ছিল?”

ধওয়ান বলেন,  “আমরা এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বাস করি। আমার এক মক্কেল আছেন, তিনি শিখ। তিনি বলছেন, ওয়াকফে সম্পত্তি দিতে চান। আমি আশা করি ওই সম্মত্তি কেড়ে নেওয়া হবে না।”