১৮ জুন ২০২৫, বুধবার, ৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পূর্ণ মনোযোগসহ নামায আদায়ের উপায়

ইমামা খাতুন
  • আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার
  • / 42

আবদুল কুদ্দুসঃ ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হল নামায। আর নামায আদায় করতে হবে একাগ্রচিত্তে, খুশু-খুজুর সঙ্গে। একবার হযরত হাতেম আসম রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হল, ‘আপনি কীভাবে নামায আদায় করেন?’ তিনি জবাবে বললেন, ‘আমি প্রথম খুব ভালোভাবে ওযূ করে নিই। ওজুর দ্বারা আল্লাহ্তায়ালা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সগীরা গুনাহগুলো মাফ করে দেন। এরপর আমি যখন নামাযে দাঁড়াই তখন মনে করি, যেন আমি পুলসিরাতের উপর দাঁড়িয়ে আছি। একটু নড়াচড়া করলেই নিচে জাহান্নামের আগুনে পড়ে যাব। মনে করি, কাবাঘর আমার সামনে। আমার ডানে জান্নাত আর বামে জাহান্নাম। পেছনে মালাকুল মউত দাঁড়িয়ে আছে। আর মনে করি, এটাই আমার জীবনের শেষ নামায।’

তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘এভাবে আপনি কতদিন ধরে নামায আদায় করছেন?’

তিনি বললেন, ‘৩০ বছর যাবত আমি এভাবেই নামায আদায় করে আসছি।’

এই কথা শুনে প্রশ্নকারী কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘আমি তো জীবনে এক ওয়াক্ত নামাযও এভাবে আদায় করতে পারিনি।’

হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. নামাযে ধ্যান-খেয়াল ও খুশু-খুজু সৃষ্টির পাঁচটি উপায় বর্ণনা করেছেন। এগুলো অবলম্বন করলে একাগ্রচিত্তে পূর্ণ মনোযোগসহ নামায আদায় করা সম্ভব।

১) যারা অর্থ বোঝে তারা অর্থের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রেখে কেরাত পড়বে।  প্রতিটি তাকবীর, তাহমীদ, তাসবীহ ও অন্যান্য দোয়া পাঠের সময় অর্থের প্রতি লক্ষ রাখবে। এর দ্বারাও মন অন্য কিছুর প্রতি ধাবিত হওয়া থেকে বিরত থাকবে।

২) কখনও পবিত্র কুরআনে কারীমের এমন অংশ তেলাওয়াত করা হয়  যার অর্থ আমার জানা নেই, কিংবা মুসল্লী যদি সাধারণ মানুষ হয় তাহলে এ ক্ষেত্রে নামাযের কেরাত, তাকবীর, তাহমীদ, দোয়া ও তাসবীহ পাঠের সময় শব্দের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রাখতে হবে।

যেমন, ‘আল্লাহু আকবার’ উচ্চারণের সময় প্রতিটি অক্ষর পূর্ণ খেয়াল করে উচ্চারণ করবে। প্রথম হামযা, তারপর দুইটি লাম, এরপর হা- এভাবে প্রতিটি অক্ষর খেয়াল করে উচ্চারণ করতে হবে। অর্থ জানা না থাকলে এভাবে প্রতিটি অক্ষরের প্রতি খেয়াল করে নামায আদায় করা যেতে পারে।

৩) এই ধ্যান-খেয়ালের সঙ্গে নামায আদায় করতে হবে যেন আমি  আল্লাহ্পাককে দেখছি। আমার রব আল্লাহ্তায়ালা আমার সামনে রয়েছেন। হাদিসে জিব্রাঈলে উল্লেখ রয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেছেন: ‘‘এমনভাবে তুমি ইবাদাত করবে যেন তুমি আল্লাহ্তায়ালাকে দেখছ। এটাকে  তাসাওউফের পরিভাষায় বলা হয়, ‘মরতবায়ে মুশাহাদা’। এই ধ্যান-খেয়াল জাগ্রত রেখে কেউ নামায আদায় করলে তার মন অন্যদিকে যাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্তায়ালা তো আমাদের সর্বদাই দেখছেন। আমাদের সবকিছু তাঁর কাছে একেবারে সুস্পষ্ট। আমার বাহ্যিক সকল কর্মকাণ্ড তো দেখছেনই এমনকি আমার অন্তর কী কল্পনা করে তাও তিনি জানেন।’’

হাদিসে ‘তুমি আল্লাহ্কে দেখছ’ না বলে ‘যেন তুমি আল্লাহ্কে দেখছ’ বলা হয়েছে। কারণ, আল্লাহ্পাককে সরাসরি দেখা সম্ভব নয়; বরং আল্লাহ্পাককে দেখার ধ্যান করতে হবে। এই অবস্থা অন্তরে সৃষ্টি করে নামায আদায় করতে পারলে ইনশাআল্লাহ নামাযে মন বসবে। কোনও গোলাম মনিবকে দেখতে পেলে সে কি কোনও অন্যায় করতে পারবে? মনিবের নাফরমানি করতে পারবে? কখনোই না।

৪) যদি এই ধ্যান অন্তরে সৃষ্টি করা সম্ভব না হয়, তাহলে এই কথা খেয়াল করতে হবে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখছেন। রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেছেন: ‘এমনভাবে তুমি ইবাদাত করবে যেন তুমি আল্লাহ্তায়ালাকে দেখছ। তাঁকে দেখার এই ধ্যান সৃষ্টি করা সম্ভব না হলে তিনি তো অবশ্যই তোমাকে দেখছেন।’

এটাকে তাসাওউফের পরিভাষায় ‘মরতবায়ে মুরাকাবাহ’ বলা হয়। আল্লাহ্তায়ালা আমাকে দেখছেন এই ধ্যানে নামায আদায় করলে অবশ্যই নামাযে মন বসবে। কোনও গোলাম মনিবকে দেখতে না পেলেও যদি তার জানা থাকে, মনিব তাকে দেখছেন, তা হলে এই অবস্থায় তার পক্ষে কোনও অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। এমনিভাবে মুসল্লি যখন ‘আল্লাহ্ আমাকে দেখছেন’- এই ধ্যানের সঙ্গে নামায আদায় করবে তখন তার অন্তরে অন্য কোনও ধ্যান-খেয়াল আসবে না।

৫) নামাযে দাঁড়ানোর সময় মনে মনে এই খেয়াল করা, হতে পারে এটাই  আমার জীবনের শেষ নামায। এই নামাযের পর আমি হয়তো আর নামাযের সুযোগ পাব না। পরবর্তী নামাযের ওয়াক্ত আসার পূর্বেই আমার মৃত্যু হতে পারে। কেউ নামায আদায়ের সময় এই ধ্যান-খেয়াল সৃষ্টি করতে পারলে তার নামাযে অন্য কোনও খেয়াল আসা সম্ভব নয়।

উল্লিখিত পাঁচটির যেকোনও একটি পরিপূর্ণরূপে অবলম্বন করতে পারলে পূর্ণ ধ্যান-খেয়াল ও খুশু-খুজুর সঙ্গে নামায আদায় করা সম্ভব হবে।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

পূর্ণ মনোযোগসহ নামায আদায়ের উপায়

আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার

আবদুল কুদ্দুসঃ ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হল নামায। আর নামায আদায় করতে হবে একাগ্রচিত্তে, খুশু-খুজুর সঙ্গে। একবার হযরত হাতেম আসম রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হল, ‘আপনি কীভাবে নামায আদায় করেন?’ তিনি জবাবে বললেন, ‘আমি প্রথম খুব ভালোভাবে ওযূ করে নিই। ওজুর দ্বারা আল্লাহ্তায়ালা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সগীরা গুনাহগুলো মাফ করে দেন। এরপর আমি যখন নামাযে দাঁড়াই তখন মনে করি, যেন আমি পুলসিরাতের উপর দাঁড়িয়ে আছি। একটু নড়াচড়া করলেই নিচে জাহান্নামের আগুনে পড়ে যাব। মনে করি, কাবাঘর আমার সামনে। আমার ডানে জান্নাত আর বামে জাহান্নাম। পেছনে মালাকুল মউত দাঁড়িয়ে আছে। আর মনে করি, এটাই আমার জীবনের শেষ নামায।’

তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘এভাবে আপনি কতদিন ধরে নামায আদায় করছেন?’

তিনি বললেন, ‘৩০ বছর যাবত আমি এভাবেই নামায আদায় করে আসছি।’

এই কথা শুনে প্রশ্নকারী কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘আমি তো জীবনে এক ওয়াক্ত নামাযও এভাবে আদায় করতে পারিনি।’

হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. নামাযে ধ্যান-খেয়াল ও খুশু-খুজু সৃষ্টির পাঁচটি উপায় বর্ণনা করেছেন। এগুলো অবলম্বন করলে একাগ্রচিত্তে পূর্ণ মনোযোগসহ নামায আদায় করা সম্ভব।

১) যারা অর্থ বোঝে তারা অর্থের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রেখে কেরাত পড়বে।  প্রতিটি তাকবীর, তাহমীদ, তাসবীহ ও অন্যান্য দোয়া পাঠের সময় অর্থের প্রতি লক্ষ রাখবে। এর দ্বারাও মন অন্য কিছুর প্রতি ধাবিত হওয়া থেকে বিরত থাকবে।

২) কখনও পবিত্র কুরআনে কারীমের এমন অংশ তেলাওয়াত করা হয়  যার অর্থ আমার জানা নেই, কিংবা মুসল্লী যদি সাধারণ মানুষ হয় তাহলে এ ক্ষেত্রে নামাযের কেরাত, তাকবীর, তাহমীদ, দোয়া ও তাসবীহ পাঠের সময় শব্দের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রাখতে হবে।

যেমন, ‘আল্লাহু আকবার’ উচ্চারণের সময় প্রতিটি অক্ষর পূর্ণ খেয়াল করে উচ্চারণ করবে। প্রথম হামযা, তারপর দুইটি লাম, এরপর হা- এভাবে প্রতিটি অক্ষর খেয়াল করে উচ্চারণ করতে হবে। অর্থ জানা না থাকলে এভাবে প্রতিটি অক্ষরের প্রতি খেয়াল করে নামায আদায় করা যেতে পারে।

৩) এই ধ্যান-খেয়ালের সঙ্গে নামায আদায় করতে হবে যেন আমি  আল্লাহ্পাককে দেখছি। আমার রব আল্লাহ্তায়ালা আমার সামনে রয়েছেন। হাদিসে জিব্রাঈলে উল্লেখ রয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেছেন: ‘‘এমনভাবে তুমি ইবাদাত করবে যেন তুমি আল্লাহ্তায়ালাকে দেখছ। এটাকে  তাসাওউফের পরিভাষায় বলা হয়, ‘মরতবায়ে মুশাহাদা’। এই ধ্যান-খেয়াল জাগ্রত রেখে কেউ নামায আদায় করলে তার মন অন্যদিকে যাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্তায়ালা তো আমাদের সর্বদাই দেখছেন। আমাদের সবকিছু তাঁর কাছে একেবারে সুস্পষ্ট। আমার বাহ্যিক সকল কর্মকাণ্ড তো দেখছেনই এমনকি আমার অন্তর কী কল্পনা করে তাও তিনি জানেন।’’

হাদিসে ‘তুমি আল্লাহ্কে দেখছ’ না বলে ‘যেন তুমি আল্লাহ্কে দেখছ’ বলা হয়েছে। কারণ, আল্লাহ্পাককে সরাসরি দেখা সম্ভব নয়; বরং আল্লাহ্পাককে দেখার ধ্যান করতে হবে। এই অবস্থা অন্তরে সৃষ্টি করে নামায আদায় করতে পারলে ইনশাআল্লাহ নামাযে মন বসবে। কোনও গোলাম মনিবকে দেখতে পেলে সে কি কোনও অন্যায় করতে পারবে? মনিবের নাফরমানি করতে পারবে? কখনোই না।

৪) যদি এই ধ্যান অন্তরে সৃষ্টি করা সম্ভব না হয়, তাহলে এই কথা খেয়াল করতে হবে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখছেন। রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেছেন: ‘এমনভাবে তুমি ইবাদাত করবে যেন তুমি আল্লাহ্তায়ালাকে দেখছ। তাঁকে দেখার এই ধ্যান সৃষ্টি করা সম্ভব না হলে তিনি তো অবশ্যই তোমাকে দেখছেন।’

এটাকে তাসাওউফের পরিভাষায় ‘মরতবায়ে মুরাকাবাহ’ বলা হয়। আল্লাহ্তায়ালা আমাকে দেখছেন এই ধ্যানে নামায আদায় করলে অবশ্যই নামাযে মন বসবে। কোনও গোলাম মনিবকে দেখতে না পেলেও যদি তার জানা থাকে, মনিব তাকে দেখছেন, তা হলে এই অবস্থায় তার পক্ষে কোনও অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। এমনিভাবে মুসল্লি যখন ‘আল্লাহ্ আমাকে দেখছেন’- এই ধ্যানের সঙ্গে নামায আদায় করবে তখন তার অন্তরে অন্য কোনও ধ্যান-খেয়াল আসবে না।

৫) নামাযে দাঁড়ানোর সময় মনে মনে এই খেয়াল করা, হতে পারে এটাই  আমার জীবনের শেষ নামায। এই নামাযের পর আমি হয়তো আর নামাযের সুযোগ পাব না। পরবর্তী নামাযের ওয়াক্ত আসার পূর্বেই আমার মৃত্যু হতে পারে। কেউ নামায আদায়ের সময় এই ধ্যান-খেয়াল সৃষ্টি করতে পারলে তার নামাযে অন্য কোনও খেয়াল আসা সম্ভব নয়।

উল্লিখিত পাঁচটির যেকোনও একটি পরিপূর্ণরূপে অবলম্বন করতে পারলে পূর্ণ ধ্যান-খেয়াল ও খুশু-খুজুর সঙ্গে নামায আদায় করা সম্ভব হবে।