‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’— পবিত্র মিনায় শুরু হজের মহাযাত্রা

- আপডেট : ৪ জুন ২০২৫, বুধবার
- / 39
পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: দু’চোখে অশ্রু, হৃদয়ে ঈমান, আর ঠোঁটে উচ্চারিত হচ্ছে অনবরত সেই পবিত্র ধ্বনি— ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শরিকা লাকা লাব্বাইক।’ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আগত মুসলিমরা সমবেত কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত করলেন প্রভুর ডাকে সাড়া দেওয়ার অঙ্গীকার এবং আত্মসমর্পণের ঘোষণা। সাদা দু’টি ইহরাম পরিধান করে, ভেদাভেদ ভুলে একক ঐক্যের চিহ্ন হয়ে, মুসলিম উম্মাহ বুধবার সকাল থেকে জড়ো হন পবিত্র মিনা প্রান্তরে, যেখানে শুরু হয়েছে হজ ২০২৫ বা ১৪৪৬ হিজরি হজের আনুষ্ঠানিকতা। এই দিনটি পরিচিত ‘ইয়াওমুত তারওয়িয়া’ নামে; অর্থাৎ প্রস্তুতির দিন হিসাবে।
বছরের প্রায় পুরোটা সময়ই নিঃশধে ঘুমিয়ে থাকা পাহাড়ঘেরা মিনা আজ যেন হঠাৎ করেই প্রাণে ভরে উঠেছে। শত শত সাদা তাঁবুর সারিতে এখন জমেছে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা মুসলিমদের ঢল। তাদের ভাষা আলাদা, বর্ণ ভিন্ন, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যময়, তবুও আজ সবার পরিচয় এক। সকলেই আল্লাহ-র ঘরের মেহমান। মিনার শান্ত নির্জনতায় আজ প্রতিটি কোণে ধ্বনিত হচ্ছে দোয়া, তাসবিহ, কুরআন তেলাওয়াত আর কান্নাভেজা কণ্ঠের আকুল প্রার্থনা।
এই মিনায় রয়েছে জামারাত স্তম্ভ, যেখানে হাজিরা হজের শেষ দিকে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করেন। এটি ইব্রাহিম (আঃ)-এর সেই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণ যেখানে তিনি শয়তানের ধোঁকা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পাশেই রয়েছে মসজিদে খাইফ, যেখানে বহু নবী নামায আদায় করেছিলেন। ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা এবং আত্মত্যাগের এক অপূর্ব মেলবন্ধনের সাক্ষী দিয়ে চলেছে মসজিদে খাইফ। ৯ যিলহজ্জ, হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। একে বলা হয় ‘ইয়াওমে আরাফাহ’।
এই দিনে হাজিরা মিনা থেকে রওনা দেবেন আরাফাতের ময়দানে, যেখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করাই হজের মূল স্তম্ভ। এখানেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৬৩২ খ্রিস্টাধে বিদায় হজের বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই বিখ্যাত ভাষণ মানবাধিকারের চিরন্তন ঘোষণা হিসেবে ইতিহাসে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিয়েছে।
আরাফাতে অবস্থান কেবল এক জায়গায় উপস্থিত থাকা নয়, বরং এটি এক আত্মবিশ্লেষণের মুহূর্ত; আত্মার সঙ্গে আল্লাহ্র একান্ত সাক্ষাৎ। হাজিরা এখানে জোহর ও আসরের নামায একসঙ্গে আদায় করেন, শ্রবণ করেন হজের খুতবা এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আত্মসমর্পণ করেন মুনাজাত, দোয়া ও কান্নায়। আরাফাত থেকে সূর্যাস্তের পর হাজিরা রওনা হন মুজদালিফার উদ্দেশ্যে। এখানে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়ে, নামায আদায় করে, শয়তানকে পাথর মারার জন্য পাথর সংগ্রহ করেন তাঁরা। এই রাতের প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এই সময়টিতে আল্লাহ-র রহমত সবচেয়ে কাছাকাছি এসে হাজির হয়।
পরদিন ১০ যিলহজ্জ, ঈদ-উল আযহার দিন। এই দিনেই সম্পন্ন হয় হজের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রুকন। সবার আগে হাজিরা জামারাতের প্রথম স্তম্ভে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করেন; এই কর্মটি শয়তানের প্রলোভনের বিরুদ্ধে এক প্রতীকী প্রতিবাদ, যা আত্মসংযম, ঈমান ও আত্মত্যাগের বার্তা বহন করে। এরপর তাঁরা পশু কুরবানি করেন; যা ইব্রাহিম (আ.)-এর সেই স্মরণীয় আত্মত্যাগের অনুকরণ যেখানে তিনি আল্লাহ-র আদেশে নিজ পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কুরবান করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। পরে হাজিরা যান মক্কা শরীফে, সেখানে আদায় করেন তাওয়াফে জিয়ারত।
কাবা শরীফকে সাতবার ঘিরে তাওয়াফ করে এবং সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাতবার সাঈ সম্পন্ন করেন, যা হাজেরা (আ.)-এর পানি খোঁজার স্মৃতি-বিজড়িত ঘটনা। এই রীতি শেষে তাঁরা জমজম কূপের পানি পান করেন। হাজিরা এরপর মিনা-তে ফিরে ১১ ও ১২ যিলহজ্জ অথবা ১৩ যিলহজ্জ পর্যন্ত অবস্থান করেন। প্রতিদিন তাঁরা তিনটি জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করেন। এই সময়টিতে তাঁরা প্রার্থনায় থাকেন, আত্মপরীক্ষায় মগ্ন থাকেন, এবং আল্লাহ-র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
অবশেষে, তাঁরা আবার মক্কা ফিরে এসে বিদায় তাওয়াফ আদায় করেন। এই তাওয়াফ তাঁদের হজ সফরের শেষ নির্দেশনা; প্রতিটি কদমে আত্মসমর্পণ, আর প্রতিটি দৃষ্টিতে অঙ্গীকারের দীপ্তি। এই তাওয়াফের মধ্যে রয়েছে চির বিদায়, চির প্রার্থনা, এবং চির আশীর্বাদের আভাস।
হজ শুধুমাত্র একটি শারীরিক অনুশীলন নয়, এটি এক অভ্যন্তরীণ বিপ্লব; আত্মশুদ্ধির মহান উপলক্ষ্য। এটি আমাদের শেখায় কীভাবে ইব্রাহিম (আ.), হাজেরা (আ.), ও ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগ, ধৈর্য ও আল্লাহ-র প্রতি নিঃশর্ত বিশ্বাস এক যুগান্তকারী ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল।
এই যাত্রায় হাজিরা কাঁধে কেবল ব্যাগ বহন করেন না, তাঁরা বহন করেন সমস্ত গুনাহ মাফের আকুতি, দোয়ার আবেদন ও আত্মনিবেদনের প্রতিজ্ঞা। প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি ‘লাব্বাইক’- ধ্বনিতে ফুটে ওঠে বিনয়, ভালোবাসা, দুনিয়াবি সব অহংকার বিসর্জনের আকাঙ্ক্ষা।