২৪ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার, ৯ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান: চার দশকের প্রতীক্ষা, রাজ্যের উদ্যোগেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু

আফিয়া‌‌ নৌশিন
  • আপডেট : ২৪ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার
  • / 18

পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান—একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, যার বর্ষপূর্তি হয় পরিকল্পনার, বাস্তবায়নের নয়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল শহর এবং তার সংলগ্ন গ্রামাঞ্চল প্রতি বছর একাধিকবার ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। রাজ্যের মধ্যে ঘাটালই একমাত্র পুরসভা এলাকা, যেখানে প্রতিবছরই জলবন্দি অবস্থায় থাকতে হয় নাগরিকদের। আর গ্রামীণ এলাকার অবস্থা হয় আরও ভয়াবহ।

ঘাটালের প্রধান সমস্যা নদী ও নিকাশিনালা ঘিরে। কেলেঘাই ও কপালেশ্বরী নদী এই এলাকায় একাধিকবার জলস্তর বৃদ্ধি ঘটিয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত করে দেয়। তাই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান ছিল অত্যন্ত জরুরি। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বন্যার প্রকোপ থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়ার আশা ছিল।

রাজ্যের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্প অনুমোদন করলেও অর্থ বরাদ্দ করেনি। এমনকি বিজেপি শাসিত কেন্দ্র, প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তি ও অনুমোদন সত্ত্বেও, আজও এক টাকাও দেয়নি। তাই রাজ্য সরকার নিজেদের অর্থেই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু করেছে। দুই বছরের মধ্যে তা শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: প্লাবিত ঘাটালে শ্বাসকষ্টে গৃহবধূ, ১০ কিমি জলপথে অক্সিজেন নিয়ে ছুটল পুলিশ

প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে এই প্রকল্প নিয়ে চলে আসছে টানাপড়েন। ১৯৮৩ সালে রাজ্যের তৎকালীন সেচমন্ত্রী প্রভাস রায় এই প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। কিন্তু প্রকৃত কাজ আর শুরু হয়নি। ১৯৯৩ সালে স্থানীয় বাসিন্দারা গঠন করেন ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি’। তাতেও প্রকল্প এগোয়নি।

আরও পড়ুন: রাজ্যে জারি অরেঞ্জ অ্যালার্ট, ভাসবে একের পর এক এলাকা

২০০৯ সালে রাজ্য সরকার ফের এই প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২০১০ সালে গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশনের (GFCC) কাছে জমা পড়ে ডিটেলড প্রোজেক্ট রিপোর্ট (DPR)। কেন্দ্র সেই রিপোর্ট পর্যালোচনা করে আরও তথ্য চেয়ে ফেরত পাঠায়। ২০১৪ সালে আবার নতুন করে ১২১২ কোটি টাকার DPR জমা দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় সরকারের জলশক্তি মন্ত্রকের অধীন GFCC-র কাছে।

দীর্ঘ মূল্যায়নের পর ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ১২৩৮.৯৫ কোটি টাকার ছাড়পত্র দেয়। একই বছর প্রকল্পটিকে ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা ও সীমান্ত এলাকা কর্মসূচি’র আওতায় আনার ঘোষণা করা হয়। তবে তারপর থেকে প্রকল্প আর এগোয়নি বলেই অভিযোগ রাজ্যের।

রাজ্য সরকারের বক্তব্য, কেন্দ্রের এই দীর্ঘদিনের অসহযোগিতার ফলে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন, রাজ্যের নিজস্ব তহবিলেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাতটি মৃতপ্রায় নদী পুনঃখননের কাজ হয়েছে, খরচ হয়েছে ৩৪১.৪৯ কোটি টাকা।

বর্তমানে রাজ্য সরকারের তরফে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ১৫০০ কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কাজ শুরু হয়েছে এবং আগামী দুই বছরের মধ্যে তা শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। চলতি বছরে বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। পাঁচটি স্লুইস গেটের কাজ ইতিমধ্যেই ৬০-৭০ শতাংশ সম্পূর্ণ।

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের গুরুত্ব ও বর্তমান অগ্রগতি

রাজ্য একমাত্র পুরসভা ঘাটালে প্রতি বছর বন্যা

কেলেঘাই ও কপালেশ্বরী নদীর জলস্ফীতি মূল কারণ

১৯৮৩ সালে শিলান্যাস, ৪০ বছরেও সম্পূর্ণ নয়

২০১৪ সালে DPR জমা, ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ছাড়পত্র

কেন্দ্রের অর্থ বরাদ্দ না হওয়ায় রাজ্যের নিজস্ব অর্থে কাজ

মোট ব্যয়: ১৫০০ কোটি, প্রাথমিক বরাদ্দ: ৫০০ কোটি

২০২7 সালের মধ্যে কাজ শেষের লক্ষ্যমাত্রা

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান এখন শুধু একটি প্রকল্প নয়, বরং রাজ্যের এক বৃহৎ প্রতিশ্রুতি। কেন্দ্রের পক্ষ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে সহযোগিতা না মেলার অভিযোগ থাকলেও, রাজ্য সরকার ঘাটালের মানুষকে স্থায়ী বন্যামুক্তির পথ দেখাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এখন দেখার, এই প্রকল্প ঘাটালবাসীর বহু দশকের অপেক্ষার কতটা অবসান ঘটাতে পারে।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান: চার দশকের প্রতীক্ষা, রাজ্যের উদ্যোগেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু

আপডেট : ২৪ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার

পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান—একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, যার বর্ষপূর্তি হয় পরিকল্পনার, বাস্তবায়নের নয়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল শহর এবং তার সংলগ্ন গ্রামাঞ্চল প্রতি বছর একাধিকবার ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। রাজ্যের মধ্যে ঘাটালই একমাত্র পুরসভা এলাকা, যেখানে প্রতিবছরই জলবন্দি অবস্থায় থাকতে হয় নাগরিকদের। আর গ্রামীণ এলাকার অবস্থা হয় আরও ভয়াবহ।

ঘাটালের প্রধান সমস্যা নদী ও নিকাশিনালা ঘিরে। কেলেঘাই ও কপালেশ্বরী নদী এই এলাকায় একাধিকবার জলস্তর বৃদ্ধি ঘটিয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত করে দেয়। তাই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান ছিল অত্যন্ত জরুরি। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বন্যার প্রকোপ থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়ার আশা ছিল।

রাজ্যের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্প অনুমোদন করলেও অর্থ বরাদ্দ করেনি। এমনকি বিজেপি শাসিত কেন্দ্র, প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তি ও অনুমোদন সত্ত্বেও, আজও এক টাকাও দেয়নি। তাই রাজ্য সরকার নিজেদের অর্থেই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু করেছে। দুই বছরের মধ্যে তা শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: প্লাবিত ঘাটালে শ্বাসকষ্টে গৃহবধূ, ১০ কিমি জলপথে অক্সিজেন নিয়ে ছুটল পুলিশ

প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে এই প্রকল্প নিয়ে চলে আসছে টানাপড়েন। ১৯৮৩ সালে রাজ্যের তৎকালীন সেচমন্ত্রী প্রভাস রায় এই প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। কিন্তু প্রকৃত কাজ আর শুরু হয়নি। ১৯৯৩ সালে স্থানীয় বাসিন্দারা গঠন করেন ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি’। তাতেও প্রকল্প এগোয়নি।

আরও পড়ুন: রাজ্যে জারি অরেঞ্জ অ্যালার্ট, ভাসবে একের পর এক এলাকা

২০০৯ সালে রাজ্য সরকার ফের এই প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২০১০ সালে গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশনের (GFCC) কাছে জমা পড়ে ডিটেলড প্রোজেক্ট রিপোর্ট (DPR)। কেন্দ্র সেই রিপোর্ট পর্যালোচনা করে আরও তথ্য চেয়ে ফেরত পাঠায়। ২০১৪ সালে আবার নতুন করে ১২১২ কোটি টাকার DPR জমা দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় সরকারের জলশক্তি মন্ত্রকের অধীন GFCC-র কাছে।

দীর্ঘ মূল্যায়নের পর ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ১২৩৮.৯৫ কোটি টাকার ছাড়পত্র দেয়। একই বছর প্রকল্পটিকে ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা ও সীমান্ত এলাকা কর্মসূচি’র আওতায় আনার ঘোষণা করা হয়। তবে তারপর থেকে প্রকল্প আর এগোয়নি বলেই অভিযোগ রাজ্যের।

রাজ্য সরকারের বক্তব্য, কেন্দ্রের এই দীর্ঘদিনের অসহযোগিতার ফলে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন, রাজ্যের নিজস্ব তহবিলেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাতটি মৃতপ্রায় নদী পুনঃখননের কাজ হয়েছে, খরচ হয়েছে ৩৪১.৪৯ কোটি টাকা।

বর্তমানে রাজ্য সরকারের তরফে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ১৫০০ কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কাজ শুরু হয়েছে এবং আগামী দুই বছরের মধ্যে তা শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। চলতি বছরে বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। পাঁচটি স্লুইস গেটের কাজ ইতিমধ্যেই ৬০-৭০ শতাংশ সম্পূর্ণ।

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের গুরুত্ব ও বর্তমান অগ্রগতি

রাজ্য একমাত্র পুরসভা ঘাটালে প্রতি বছর বন্যা

কেলেঘাই ও কপালেশ্বরী নদীর জলস্ফীতি মূল কারণ

১৯৮৩ সালে শিলান্যাস, ৪০ বছরেও সম্পূর্ণ নয়

২০১৪ সালে DPR জমা, ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ছাড়পত্র

কেন্দ্রের অর্থ বরাদ্দ না হওয়ায় রাজ্যের নিজস্ব অর্থে কাজ

মোট ব্যয়: ১৫০০ কোটি, প্রাথমিক বরাদ্দ: ৫০০ কোটি

২০২7 সালের মধ্যে কাজ শেষের লক্ষ্যমাত্রা

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান এখন শুধু একটি প্রকল্প নয়, বরং রাজ্যের এক বৃহৎ প্রতিশ্রুতি। কেন্দ্রের পক্ষ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে সহযোগিতা না মেলার অভিযোগ থাকলেও, রাজ্য সরকার ঘাটালের মানুষকে স্থায়ী বন্যামুক্তির পথ দেখাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এখন দেখার, এই প্রকল্প ঘাটালবাসীর বহু দশকের অপেক্ষার কতটা অবসান ঘটাতে পারে।