০৮ জুন ২০২৫, রবিবার, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জুলুমের করতলে সভ্য পৃথিবী

সুস্মিতা
  • আপডেট : ৭ জুন ২০২৫, শনিবার
  • / 39

শুক্রবার ঈদ-উল-আযহা পালিত হয়েছে আরব দুনিয়ায় এবং আরও কিছু রাষ্ট্রে। ঈদ-উল-আযহা ত্যাগ, তিতীক্ষা, সব্র এবং আল্লাহ্-প্রেমের অনুশীলন। ঈদ-উল-আযহা’র এই সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল ফিলিস্তিনের ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজায় এক রুগ্ন কিশোরী কবর দেওয়ার জন্য হঠাৎ তড়িঘড়ি গড়ে তোলা এক কবরস্থানে হেঁটে যাচ্ছে। হয়তো এই গোরস্থানে সে খুঁজছে তার হারিয়ে যাওয়া মা-ভাই-বোন কিংবা বাবাকে। হয়তো বা দেখছে পরিচয়-ফলকে তার কোনও আত্মীয়-স্বজনের নাম আছে কি না। হ্যাঁ, নেতানিয়াহু’র বধ্যভূমিতে ইতিমধ্যেই ৫৬,০০০ শিশু, নারী, বৃদ্ধ, বেসামরিক অসহায় ফিলিস্তিনির গণহত্যা সম্পন্ন হয়েছে। এই নারকীয় ঘটনা সম্পন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে সভ্য বিশ্বের চোখের সামনে। কারও কোনও প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ সামনে আসছে না। ফিলিস্তিনিরা একাই লড়ে যাচ্ছে। শুক্রবারও তারা হার না মেনে গণহত্যাকারী দখলদার ইসরাইলি সেনাদের ৫ জনকে এক আক্রমণ দ্বারা হত্যা করেছে। আহত হয়েছে বেশ কয়েকজন। তারা ইসরাইলি এলিট সেনাবাহিনীর অংশ ছিল।

হ্যাঁ, সউদি, দুবাই, শারজা, মিশর, লিবিয়া প্রভৃতি স্থানের শাসক রাজা-বাদশাহ এবং সামরিক সেনা নায়করা আমোদ-বিলাসিতা-বিনোদনে ঈদ উদযাপন করেছেন। তাঁদের কিন্তু মনেও পড়েনি গাজার ক্ষুধার্ত শিশু, নারী, বৃদ্ধদের কথা। তারা ইসরাইল এবং আমেরিকার ট্রাম্পের পদলেহন করতেই ব্যস্ত। ট্রাম্পকে তাঁর সফরে এই শাসকরা যে পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন তাকে কল্পনার উর্ধ্বে বললেও ভুল হবে না। এ যেন কোনও বাদশাহ সফরে বেরিয়েছেন। আর করদ রাজ্যগুলি তাদের বাদশাহকে তুষ্ট করার জন্য উপঢৌকন পেশ করছে।

তবে এর মধ্যেও দু’টি রাষ্ট্রের কথা আলাদা করে উল্লেখ করতে হবে। দেশ দু’টি হচ্ছে ইয়েমেন ও ইরান। এ দু’টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনে তাদের সুন্নী ভাইদের সমর্থনে প্রাণ বাজি রেখে ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছেন। আর ইয়েমেন তো বলদর্পী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইসরাইলের স্বার্থের উপর হামলা করতেও পিছপা হচ্ছে না। বলা যায়, তারা প্রতিরোধের মাধ্যমে ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করছে। অন্তত সর্বগ্রাসী জুলুমের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষুদ্র অবস্থান তাই বলে।

প্রশ্ন উঠবেই, ফিলিস্তিনের দোষ কোথায়? বৃহৎ শক্তিগুলি অটোমান খিলাফতের দুর্বলতার সুযোগে এবং খিলাফত নিযুক্ত কিছু আরব শাসকের বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে ব্রিটেন আধিপত্য কায়েম করে। আর এই অবস্থায় তারা সারা দুনিয়া থেকে ইহুদিদের জড়ো করে এনে ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৪৮ সালে পশ্চিমা মদদে এই রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠা ঘটে।
প্রথমে পবিত্র শহর জেরুসালেম ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল খ্রিস্টান, মুসলিম এবং ইহুদিদের কাছে পবিত্র জেরুসালেম দখল করে। আর মসজিদু আক্সাও এই যায়নবাদীদের হাতে চলে যায়। এখন উড়ে এসে জুড়ে বসা ইহুদিরা ফিলিস্তিনের সঙ্গে কি ব্যবহার করছে, তা সারা বিশ্ব ৭৫ বছর ধরে প্রত্যক্ষ করছে।

ইসরাইলের এই আধিপত্যের পিছনে রয়েছে পশ্চিমা দুনিয়ার মদদ। তারা যায়নবাদী ইসরাইলকে অর্থ, অস্ত্রের জোগান দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। পশ্চিমা খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলির সুদূরপ্রসারী এক পরিকল্পনার জন্যই তারা নয়া ইহুদি রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রেখেছে। পশ্চিমাদের ইসলামফোবিয়া এর অন্যতম কারণ। তাদের স্কলার এবং পরিকল্পনাকারীরা মনে করে যদি ভবিষ্যতে কখনও ইসলামী শক্তি ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা পশ্চিমা ও ইহুদি স্বার্থের, তাদের শোষণ ও জুলুমবাজীর দফারফা করে দেবে। তাই তারা যেকোনও মূল্যে ইসরাইলকে টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। এই পৈশাচিক হত্যা ও ধ্বংসলীলা বন্ধের জন্য মুখে যুদ্ধবিরতির কথা বললেও যখন দু’দিন আগে রাষ্ট্রসংঘে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের ভোট হয়েছে, তখন সভ্য দুনিয়ার মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে এবং যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা সম্পূর্ণ খারিজ করে দিয়েছে। তারা ইসরাইলকে অবাধ ধ্বংস ও গণহত্যা চালানোর সম্পূর্ণ লাইসেন্স প্রদান করেছে।

সবথেকে লজ্জার বিষয়, এত মানুষ নিহত ও আহত হওয়ার পরও এবং গাজাকে সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেও পশ্চিমা বিশ্ব এই ঘটনাকে জেনোসাইড বলতে রাজি নয়। সভ্য পৃথিবীতেও তাদেরই তাঁবেদার। তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ইসরাইলের এখন অস্ত্র হচ্ছে মিডিয়ার মাধ্যমে অনবরত মিথ্যাচার এবং ক্ষুধাকে হত্যার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা। আর এতেই তারা সফল, তাতে সন্দেহ নেই।

আমাদের ভারতেও ইসলামফোবিয়ায় এবং মুসলিম বিদ্বেষকে হাতিয়ার করা শুরু হয়েছে। এর পিছনে যে ‘উজ্জ্বল মুখ’গুলি ভেসে উঠছে তার মধ্যে রয়েছে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, যোগী আদিত্যনাথ, অমিত শাহ প্রমুখ। ভারত ভাগের আগে অসমে দেড়শো বছর ধরে বসবাস করা পূর্ববঙ্গমূলের ভারতীয়দের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেভাবে ঠেলে বাংলাদেশে ফেলে আসা হচ্ছে তাকে অমানবিকতা এবং বেইনসাফির চূড়ান্ত রূপ বলা যায়। আমরা আল্লাহ্’র কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন এই পৃথিবীকে দূষণমুক্ত করে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন। ঈদ মোবারক!

Tag :

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

জুলুমের করতলে সভ্য পৃথিবী

আপডেট : ৭ জুন ২০২৫, শনিবার

শুক্রবার ঈদ-উল-আযহা পালিত হয়েছে আরব দুনিয়ায় এবং আরও কিছু রাষ্ট্রে। ঈদ-উল-আযহা ত্যাগ, তিতীক্ষা, সব্র এবং আল্লাহ্-প্রেমের অনুশীলন। ঈদ-উল-আযহা’র এই সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল ফিলিস্তিনের ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজায় এক রুগ্ন কিশোরী কবর দেওয়ার জন্য হঠাৎ তড়িঘড়ি গড়ে তোলা এক কবরস্থানে হেঁটে যাচ্ছে। হয়তো এই গোরস্থানে সে খুঁজছে তার হারিয়ে যাওয়া মা-ভাই-বোন কিংবা বাবাকে। হয়তো বা দেখছে পরিচয়-ফলকে তার কোনও আত্মীয়-স্বজনের নাম আছে কি না। হ্যাঁ, নেতানিয়াহু’র বধ্যভূমিতে ইতিমধ্যেই ৫৬,০০০ শিশু, নারী, বৃদ্ধ, বেসামরিক অসহায় ফিলিস্তিনির গণহত্যা সম্পন্ন হয়েছে। এই নারকীয় ঘটনা সম্পন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে সভ্য বিশ্বের চোখের সামনে। কারও কোনও প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ সামনে আসছে না। ফিলিস্তিনিরা একাই লড়ে যাচ্ছে। শুক্রবারও তারা হার না মেনে গণহত্যাকারী দখলদার ইসরাইলি সেনাদের ৫ জনকে এক আক্রমণ দ্বারা হত্যা করেছে। আহত হয়েছে বেশ কয়েকজন। তারা ইসরাইলি এলিট সেনাবাহিনীর অংশ ছিল।

হ্যাঁ, সউদি, দুবাই, শারজা, মিশর, লিবিয়া প্রভৃতি স্থানের শাসক রাজা-বাদশাহ এবং সামরিক সেনা নায়করা আমোদ-বিলাসিতা-বিনোদনে ঈদ উদযাপন করেছেন। তাঁদের কিন্তু মনেও পড়েনি গাজার ক্ষুধার্ত শিশু, নারী, বৃদ্ধদের কথা। তারা ইসরাইল এবং আমেরিকার ট্রাম্পের পদলেহন করতেই ব্যস্ত। ট্রাম্পকে তাঁর সফরে এই শাসকরা যে পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন তাকে কল্পনার উর্ধ্বে বললেও ভুল হবে না। এ যেন কোনও বাদশাহ সফরে বেরিয়েছেন। আর করদ রাজ্যগুলি তাদের বাদশাহকে তুষ্ট করার জন্য উপঢৌকন পেশ করছে।

তবে এর মধ্যেও দু’টি রাষ্ট্রের কথা আলাদা করে উল্লেখ করতে হবে। দেশ দু’টি হচ্ছে ইয়েমেন ও ইরান। এ দু’টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনে তাদের সুন্নী ভাইদের সমর্থনে প্রাণ বাজি রেখে ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছেন। আর ইয়েমেন তো বলদর্পী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইসরাইলের স্বার্থের উপর হামলা করতেও পিছপা হচ্ছে না। বলা যায়, তারা প্রতিরোধের মাধ্যমে ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করছে। অন্তত সর্বগ্রাসী জুলুমের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষুদ্র অবস্থান তাই বলে।

প্রশ্ন উঠবেই, ফিলিস্তিনের দোষ কোথায়? বৃহৎ শক্তিগুলি অটোমান খিলাফতের দুর্বলতার সুযোগে এবং খিলাফত নিযুক্ত কিছু আরব শাসকের বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে ব্রিটেন আধিপত্য কায়েম করে। আর এই অবস্থায় তারা সারা দুনিয়া থেকে ইহুদিদের জড়ো করে এনে ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৪৮ সালে পশ্চিমা মদদে এই রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠা ঘটে।
প্রথমে পবিত্র শহর জেরুসালেম ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল খ্রিস্টান, মুসলিম এবং ইহুদিদের কাছে পবিত্র জেরুসালেম দখল করে। আর মসজিদু আক্সাও এই যায়নবাদীদের হাতে চলে যায়। এখন উড়ে এসে জুড়ে বসা ইহুদিরা ফিলিস্তিনের সঙ্গে কি ব্যবহার করছে, তা সারা বিশ্ব ৭৫ বছর ধরে প্রত্যক্ষ করছে।

ইসরাইলের এই আধিপত্যের পিছনে রয়েছে পশ্চিমা দুনিয়ার মদদ। তারা যায়নবাদী ইসরাইলকে অর্থ, অস্ত্রের জোগান দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। পশ্চিমা খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলির সুদূরপ্রসারী এক পরিকল্পনার জন্যই তারা নয়া ইহুদি রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রেখেছে। পশ্চিমাদের ইসলামফোবিয়া এর অন্যতম কারণ। তাদের স্কলার এবং পরিকল্পনাকারীরা মনে করে যদি ভবিষ্যতে কখনও ইসলামী শক্তি ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা পশ্চিমা ও ইহুদি স্বার্থের, তাদের শোষণ ও জুলুমবাজীর দফারফা করে দেবে। তাই তারা যেকোনও মূল্যে ইসরাইলকে টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। এই পৈশাচিক হত্যা ও ধ্বংসলীলা বন্ধের জন্য মুখে যুদ্ধবিরতির কথা বললেও যখন দু’দিন আগে রাষ্ট্রসংঘে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের ভোট হয়েছে, তখন সভ্য দুনিয়ার মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে এবং যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা সম্পূর্ণ খারিজ করে দিয়েছে। তারা ইসরাইলকে অবাধ ধ্বংস ও গণহত্যা চালানোর সম্পূর্ণ লাইসেন্স প্রদান করেছে।

সবথেকে লজ্জার বিষয়, এত মানুষ নিহত ও আহত হওয়ার পরও এবং গাজাকে সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেও পশ্চিমা বিশ্ব এই ঘটনাকে জেনোসাইড বলতে রাজি নয়। সভ্য পৃথিবীতেও তাদেরই তাঁবেদার। তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ইসরাইলের এখন অস্ত্র হচ্ছে মিডিয়ার মাধ্যমে অনবরত মিথ্যাচার এবং ক্ষুধাকে হত্যার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা। আর এতেই তারা সফল, তাতে সন্দেহ নেই।

আমাদের ভারতেও ইসলামফোবিয়ায় এবং মুসলিম বিদ্বেষকে হাতিয়ার করা শুরু হয়েছে। এর পিছনে যে ‘উজ্জ্বল মুখ’গুলি ভেসে উঠছে তার মধ্যে রয়েছে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, যোগী আদিত্যনাথ, অমিত শাহ প্রমুখ। ভারত ভাগের আগে অসমে দেড়শো বছর ধরে বসবাস করা পূর্ববঙ্গমূলের ভারতীয়দের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেভাবে ঠেলে বাংলাদেশে ফেলে আসা হচ্ছে তাকে অমানবিকতা এবং বেইনসাফির চূড়ান্ত রূপ বলা যায়। আমরা আল্লাহ্’র কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন এই পৃথিবীকে দূষণমুক্ত করে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন। ঈদ মোবারক!