ইসরাইল-আমেরিকার 'ইচ্ছাকৃত হত্যার' অভিযোগ
গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরাইলি গুলিতে নিহত ৩, আহত ৪৮

- আপডেট : ২৯ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার
- / 110
পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: গাজায় চলমান মানবিক সংকটের মধ্যেই মঙ্গলবার দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রকে ঘিরে চরম বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত নবগঠিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর উদ্যোগে এই ত্রাণ বিতরণ শুরু হলে হাজার হাজার ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি খাদ্যের আশায় ভিড় জমান। দীর্ঘ ১১ সপ্তাহের অবরোধের কারণে গাজার বেশিরভাগ মানুষ চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
জিএইচএফ রাফাহ শহরে খাদ্য বিতরণের জন্য একটি কেন্দ্র চালু করে। গণমাধ্যম ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, খাদ্যের আশায় আসা হাজার হাজার মানুষ তারকাঁটা ও বেড়া ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। এই অবস্থায় ইসরাইলি সেনারা নির্মমভাবে গুলি চালায়।
ফিলিস্তিনের গাজার সরকারি গণসংযোগ অফিস এই ঘটনাকে ‘ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড’ এবং ‘পূর্ণমাত্রার যুদ্ধাপরাধ’ বলে আখ্যা দিয়েছে। তাদের দাবি, সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষুধার্ত মানুষকে সাহায্যের প্রলোভন দেখিয়ে সেখানে ডেকে এনে গুলি চালিয়েছে। তারা এই খাদ্য নিরাপত্তায় বিপর্যয়ের জন্য ইসরায়েলকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই ঘটনায় অন্তত ৩ জন নিহত ও ৪৮ জন আহত হয়েছেন। ৭ জন নিখোঁজ থাকার কথা নিশ্চিত করেছে গাজার কর্তৃপক্ষ। জিএইচএফ দাবি করেছে যে, তারা প্রায় ৮,০০০ খাদ্য প্যাকেট বিতরণ করেছে, যা ৪৪,০০০ মানুষের অর্ধসপ্তাহের খাবারের সমতুল্য । যা গাজার মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ । অধিকাংশ মানুষকেই খালি হাতে ফিরে যেতে হয়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন, ক্ষুধা ও নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে তারা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করতে এসেছিলেন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী ত্রাণ নিতে আসা মানুষের দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করলেও, তাদের নিজস্ব ভাষ্যেই ফুটে উঠেছে অদূরদর্শিতা ও নিষ্ঠুরতার এক মর্মান্তিক চিত্র। তারা স্বীকার করেছে যে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে জিএইচএফ-এর সঙ্গে জড়িত মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধার করতে তাদের তৎপরতা শুরু করতে হয়েছিল। তাদের দাবি, গুলির শব্দ সম্ভবত ওই কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মার্কিন ভাড়াটে প্রহরীদের সতর্কতামূলক গুলি ছিল। এই বক্তব্য কার্যত ইসরাইলি বাহিনীর পরিকল্পনার অভাব এবং ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি তাদের চরম অবহেলার প্রমাণ। যেখানে হাজার হাজার মানুষ জীবন হাতে নিয়ে সামান্য খাদ্যের জন্য ছুটে আসছিল, সেখানে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পরিবর্তে সতর্কতা বা উদ্ধারের নামে চালানো গুলিই প্রমাণ করে, ইসরাইলি বাহিনী মানবিক সংকটকে কীভাবে নিছক একটি সামরিক বা কৌশলগত সমস্যা হিসেবে দেখছে। তাদের এই মনোভাবই এই মর্মান্তিক ঘটনার পেছনে মূল কারণ।
জিএইচএফ নামের এই সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সমর্থনে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সমালোচকদের মতে, গাজার প্রকৃত মানবিক প্রয়োজনের পরিবর্তে রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই বিতরণ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের চিত্রকে ‘হৃদয়বিদারক’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, রাষ্ট্রসংঘ এবং তাদের অংশীদারদের একটি সুসংগঠিত ও নীতিনির্ভর পরিকল্পনা আছে, যা মানবিক নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, কিন্তু জিএইচএফ-এর পরিকল্পনা মানবিক মানদণ্ড পূরণ করে না।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, জিএইচএফ-এর ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে কিছু সময়ের জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, তবে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন, গাজায় কেউ অপুষ্টিতে ভুগছে এমন প্রমাণ নেই এবং যুদ্ধের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একজন কৃশকায় লোকও দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এই ঘটনাকে কেবল ‘অভিযোগ জানানোর কৌশল’ বলে অবজ্ঞা করেছেন। তিনি বলেন, হামাস এই সাহায্য কার্যক্রমকে বাধা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। তার দাবি, এই মুহূর্তে গাজায় ৮ হাজার খাবার প্যাকেট সরবরাহ করা হয়েছে এবং জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও সাহায্য কার্যক্রম চলছে।
জিএইচএফ বিতর্কিত সহায়তা সংস্থা হিসেবে দাবি করেছে যে, একসময় বিকেলে এত মানুষ ভিড় করেছিল যে তাদের কর্মীরা পেছনে সরে যায়, যেন কিছু মানুষ নিরাপদে সাহায্য নিতে পারে।
রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল-এর নীতিমালা বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্ডিন ল্যাং এই ত্রাণ কার্যক্রমকে ‘মানবিক নয়, বরং সামরিকভাবে পরিকল্পিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ক্ষুধা থেকে মানুষকে বাঁচাতে খাদ্য ছাড়াও চিকিৎসা ও অপুষ্টি কেন্দ্রের প্রয়োজন হয়, কিন্তু এসব কিছুই এই পরিকল্পনায় নেই। নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি)-এর মুখপাত্র আহমেদ বায়রামও এই সাহায্য বিতরণ পদ্ধতিকে অমানবিক বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, যে দেশ রাফাহ ধ্বংস করেছে, মানুষকে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছে, এখন তারাই আবার সেখানে সাহায্য নিতে বলছে—এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
গাজার চারদিকে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ২ মার্চ থেকে ইসরাইল গাজার সব সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, ফলে কোনো আন্তর্জাতিক সাহায্য, খাবার, ওষুধ বা জ্বালানি ভেতরে ঢুকতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের মতো নিরপেক্ষ সংস্থাগুলির মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের প্রয়োজনীয়তা আরও প্রকট হয়ে উঠছে, যাতে গাজার অসহায় মানুষের কাছে সঠিকভাবে সাহায্য পৌঁছানো যায় এবং ভবিষ্যতে এমন মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো যায়।