শনি শিঙ্গনাপুর মন্দির থেকে ছাটাই ১১৪ জন মুসলিম কর্মী, পর্দার আড়ালে হিন্দুত্ববাদীরা!

- আপডেট : ১৫ জুন ২০২৫, রবিবার
- / 70
পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর জেলার বিখ্যাত শনি শিঙ্গনাপুর মন্দির। সেখানে কাজ করেন বহু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। দীর্ঘকাল ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে রয়েছে মন্দিরটি। সম্প্রতি মন্দির কর্তৃপক্ষের এক সিদ্ধান্তে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্রের খবর, মন্দিরের ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ ১৬৭ জন কর্মীকে কাজ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১১৪ জন মুসলিম কর্মচারী। শুক্রবার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সুরক্ষা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা প্রদান বিভাগে কর্মরত ১৬৭ জন কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছে।
এর মধ্যে ১১৪ জন মুসলিম কর্মচারী রয়েছে। যারা বছরের পর বছর ধরে মন্দিরে কাজ করেছেন। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিকভাবে সহাবস্থানের জন্য পরিচিত একটি দেশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বৈষম্যের নজির বলেই উল্লেখ করেছেন সমাজকর্মী থেকে বিশিষ্টরা। একইসঙ্গে এই ঘটনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাঁরা। কর্তৃপক্ষের কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত মন্দিরের ভাবমূর্তি এবং ঐতিহ্যকে ভেঙে দিয়েছে।
জানা গিয়েছে, কয়েক দশক ধরে শনি শিঙ্গনাপুর মন্দিরটি কেবল লক্ষ লক্ষ ভক্তদের জন্যই পরিচিত নয়, বরং এর সর্বব্যাপী চেতনার জন্যও পরিচিত ছিল। হিন্দু ও মুসলিম কর্মীরা যৌথভাবে মন্দিরের দৈনন্দিন কার্যক্রম মিলেমিশে করতেন। যা দেশ ও সমাজের বহুত্ববাদী নীতিকে প্রতিফলিত করে।
এই শ্রদ্ধেয় স্থানে বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থান প্রায়শই ধর্মের বাইরে ঐক্যের উদাহরণ হিসাবে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ কি কারণে কর্মীদের ছেঁটে ফেলা হল? শনি শিঙ্গনাপুর মন্দির ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে কর্মীদের অপসারণের পিছনে কারণ হিসাবে “শৃঙ্খলায় ত্রুটি” এবং “অনিয়ম” উল্লেখ করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্দিরের এক মুখপাত্র বলেন, “ট্রাস্টের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা হলো, নিয়ম না মানা এবং খারাপ পারফরম্যান্সের কারণে এই অপসারণ করা হয়েছে। এখানে ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বের প্রশ্নই ওঠে না। আমরা কঠোর শৃঙ্খলা বজায় রাখি এবং সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণরূপে প্রশাসনিক।”
মন্দির কর্তৃপক্ষ ‘শৃঙ্খলায় ত্রুটি’ এবং ‘অনিয়ম’ এর কথা উল্লেখ করলেও এর পিছনে যে হিন্দুত্ববাদীদের চাপ রয়েছে তা উড়িয়ে দিচ্ছেন না সম্প্রদায়ের নেতা এবং অধিকার কর্মীরা। তাদের কথায়, নির্দিষ্ট হিন্দু গোষ্ঠীর চাপের মুখে মুসলমানদের বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। একই সুর শোনা গিয়েছে মন্দিরের অভ্যন্তরীণ মহলে। ট্রাস্টের ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, ‘ধর্মীয় বিশুদ্ধতার’ দোহাই দিয়ে মুসলিম কর্মীদের অপসারণের দাবিতে আসা কিছু হিন্দু গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান চাপ পর্দার আড়ালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’
কাজ হারা মুসলিম কর্মচারীদের অনেকেই এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মন্দিরে কাজ করছেন। কেউ কেউ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরেও কাজ করে আসছেন। তারা সেই সময়ের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, তাদের পরিবার সাম্প্রদায়িক সীমানা অতিক্রম করে এমন এক ধর্মীয় স্থানে সেবা করতে পেরে গর্ববোধ করত। মন্দিরের সাফাইকর্মী আব্দুল রশিদ বলেন, “আমি এখানে ১৫ বছর ধরে কাজ করছি। আমার ছেলেরা তাদের বন্ধুদের বলত, যে তার বাবা শনি শিঙ্গনাপুরে কাজ করেন।
এমন একটি জায়গা যেখানে সব ধর্মের মানুষ আসেন। এখন হঠাৎ করেই আমাদের যথাযথ তদন্ত না করেই কোনও সতর্কতা না দিয়ে হঠাৎ চলে যেতে বলা হয়েছে।” আরেক কর্মী আমিনা বানো বলেন, “এই সিদ্ধান্ত অনেকের জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। এখানে কাজ করতে গিয়ে আমরা কখনো বৈষম্যের শিকার হইনি। আমাদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করা হচ্ছে দেখে কষ্ট হচ্ছে।”
আহমেদনগরের বাসিন্দা তথা সমাজকর্মী সমীর আনসারি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “দেশে এই মন্দিরটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল উদাহরণ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। মুসলিম কর্মীদের গণহারে ছাঁটাই করার মাধ্যমে একটি বিপজ্জনক বার্তা যাচ্ছে যে, মুসলমানরা বছরের পর বছর ধরে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেবা করলেও সেখানে তাদের আর মূল্য থাকবে না।
তাদের আর কেউ স্বাগত জানাবে না।” এদিকে মুসলিম কর্মচারীদের ছাঁটাই করা নিয়ে উৎকণ্ঠা রয়েছে তারা। শহরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মুসলিম ছাঁটাই শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে তারা। স্থানীয় নেতারা এই পদক্ষেপকে বৈষম্যমূলক এবং ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর লঙ্ঘন বলে নিন্দা করেছেন। আহমেদনগর জামা মসজিদের মৌলানা ইমরান কুরেশি বলেন, ‘আমাদের সংবিধানে ধর্ম নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। মন্দির এবং মসজিদ শান্তি ও সবস্থানের জায়গা হওয়া উচিত, বর্জনের স্থান নয়।”