কাজী মোতাহার হোসেনের প্রতিভা চমকে দিতে পারে আপনাকেও, প্রয়াণ দিবসে দেখে নিন এই মহাপুরুষের প্রতিভার ঝলক

- আপডেট : ৯ অক্টোবর ২০২১, শনিবার
- / 13
পুবের কলম, ওয়েবডেস্কঃ আজ (৯ অক্টোবর) কাজী মোতাহার হোসেনের প্রয়াণ দিবস। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এই মানুষটি সম্পর্কে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলতেন, ‘আপনভোলা নিরহংকার মানুষ, বিদ্বান ও গুণী।’ যাঁকে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন, “একজন উদারমনা মুসলমান ও সেই সঙ্গে দেশপ্রাণ বাঙালি এবং সকলের উপর একজন সৎ মানুষ।” তাঁর সাহিত্যের মূল্যায়ণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- তাঁর রয়েছে ‘স্বচ্ছ প্রাঞ্জল ভাষা, ‘বলবার সাহস’ ও ‘চিন্তার স্বকীয়তা’। এই মানুষটিই বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীলতা বিকাশের এক অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
কাজী মোতাহার হোসেনের জন্ম ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই, তৎকালীন নদিয়া জেলার ভালুকা (বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী) থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে।তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাজবাড়ি জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রামে। মোতাহার হোসেনের পূর্বপুরুষ মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে দিল্লি-দরবারে ধর্মীয় উপদেষ্টা ও বিচারক (কাজী) পদে নিযুক্ত ছিলেন। এই সূত্রেই মোতাহার হোসেন ‘কাজী’ পদবী লাভ করেন।
কাজী মোতাহার হোসেনের জন্ম ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই, তৎকালীন নদিয়া জেলার ভালুকা(বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী) থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাজবাড়ি জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রামে। মোতাহার হোসেনের পূর্বপুরুষ মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে দিল্লি-দরবারে ধর্মীয় উপদেষ্টা ও বিচারক (কাজী) পদে নিযুক্ত ছিলেন। এই সূত্রেই মোতাহার হোসেন ‘কাজী’ পদবী লাভ করেন।
বাবা কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ ও মা তসিরুন্নেসার আট ছেলে-মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। বাবা কাজী গওহরউদ্দীনের সরকারি চাকরি ছিল, তাঁর সংসারে অসচ্ছলতা ছিল নিত্যসঙ্গী।
কাজী মোতাহার হোসেনের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁদের দুজনের বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। বিভিন্ন চিঠিতে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে ‘মোতিহার’ বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁদের সম্পর্ক এতটাই গভীর ছিল যে, মোতাহার হোসেনের দাড়ি-কাটা নিয়ে নজরুল ‘দাড়ি-বিলাপ’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতাও লিখেছিলেন। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথেও মোতাহার হোসেনের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। এমনকি শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পটিও মোতাহার হোসেনের সঙ্গে আলাপচারিতারই ফসল। এমনটাই জানা যায়।
গণিতের প্রতি ছেলেবেলা থেকেই তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। একদম ছোটবেলায় তাঁর ছোট চাচা কাজী আবুল হোসেন তাঁকে যোগ-বিয়োগ ও গুণের পদ্ধতি শেখান, আর ছোট্ট মোতাহার নিজে নিজেই ভাগ শিখে চাচাকে অবাক করে দেন। পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও পরিসংখ্যান- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বিভাগেই অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও বিখ্যাত সংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের ছাত্র।
তিনি তাঁর ‘নজরুল কাব্য পরিচিতি’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন প্রিয় শিক্ষক প্রশান্তচন্দ্রকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহকর্মী ছিলেন বোস-আইনস্টাইন থিওরির জনক সত্যেন্দ্রনাথ বসু। কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর লেখা ‘তথ্য-গণিত’ বইটি সত্যেন বোসকে দেখানোর জন্য কলকাতায়ও গেছিলেন। আরও অনেকের সামনে সে বইয়ের ভূমিকা পড়ে বোস বলেছিলেন, “দেখ! তোমরা কেউ লিখতে পারতে? পারতে না। এ আমার ছেলে!” শুধু তা-ই নয়, সত্যেন বোস তাঁর জীবনের শেষ চিঠিটিও লিখেছিলেন মোতাহার হোসেনকে।
১৯৫০ সালে ‘Design of Experiments’ বিষয়ে গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাজী মোতাহার হোসেন ডক্টরেট (পিএইচ.ডি.) ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর থিসিসের পরীক্ষকদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত সংখ্যাতত্ত্ববিদ স্যার রোনাল্ড ফিশার। তিনিও তাঁর এই গবেষণাপত্রের উচ্চ প্রশংসা করেন। পরবর্তীতে মোতাহার হোসেনের উদ্ভাবিত একটি পদ্ধতি সংখ্যাতত্ত্বশাস্ত্রে (Statistics) ‘Hussain’s Chain Rule’ নামে পরিচিতি পায়।
মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার তাগিদ সবসময়ই অনুভব করেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। সে চিন্তা থেকেই রচনা করেন ‘তথ্য-গণিত’, ‘গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস’, ‘আলোক-বিজ্ঞান’ নামের বইগুলো। বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের বিখ্যাত ‘কোয়ান্টাম-থিওরি’ সম্পর্কিত প্রবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন এবং তা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপা হয়।
১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসেন, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখের আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় গড়ে ওঠে প্রগতিশীল সাহিত্য-সংগঠন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের বার্ষিক মুখপত্র ছিল ‘শিখা’। শিখার দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে সম্পাদক ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। শিখাগোষ্ঠীর শিখারা স্বপ্ন দেখতেন বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীন চর্চা করার সুযোগ দেয় এমন প্রগতিশীল সমাজ কাঠামো তৈরি করার। মোতাহার হোসেনও ছিলেন সেই আদর্শে বিশ্বাসী।
ধর্মান্ধতা বা কুসংস্কারের কোনও স্থান ছিল না তাঁর কাছে। কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছেন। তাঁর লেখা নিবন্ধগুলোর মধ্যে ‘অসীমের সন্ধানে’, ‘কবি ও বৈজ্ঞানিক’, ‘আনন্দ ও মুসলমান গৃহ’, ‘সঙ্গীতচর্চা ও মুসলমান’, ‘নাস্তিকের ধর্ম’, ‘মানুষ মোহাম্মদ’, ‘ভুলের মূল্য’, ‘লেখক হওয়ার পথে’ উল্লেখযোগ্য ।
সদ্য স্বাধীন হওয়া পাকিস্তানে যখন রাষ্ট্রভাষা চাপিয়ে দেওয়ার, ভাষা-সংস্কার, হরফ-পরিবর্তনের (বাংলা ভাষাকে উর্দু হরফে লেখার) চক্রান্ত চলছিল, ধর্মকে পুঁজি করে অযৌক্তিক রবীন্দ্রবিরোধিতা তুঙ্গে উঠেছিল, তখন সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। তিনি এটাও বলেছিলেন যে, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলে তা থেকে সৃষ্ট অসন্তোষে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরবর্তীতে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হয়।
কাজী মোতাহার হোসেন আরও যে কারণে বিখ্যাত ছিলেন সেটি হল দাবা। খেলাধুলার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। তাঁর দাবাখেলার সঙ্গী ছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, সতীশচন্দ্র আড্ডী (সর্বভারতীয় চ্যাম্পিয়ন), কিষাণলালের মতো বিখ্যাত লোকেরা। ১৯২৫ সালে তিনি ‘অল ইণ্ডিয়া চেজ ব্রিলিয়ান্সি’ প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। গ্র্যাণ্ডমাস্টার কাজী মোতাহার হোসেন বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং আজীবন সভাপতি ছিলেন। ফুটবল, টেনিস, হাই জাম্প, সাঁতার এবং ব্যাডমিন্টনেও তাঁর পারদর্শিতা ছিল। ১৯৫১ সালে ঢাকায় লন টেনিস প্রতিযোগিতায় তিনি চ্যাম্পিয়ন হন।